মৌনং সম্মতি লক্ষণম্!!
প্রশ্ন বিবিধ।অথচ উত্তর অজানা।কারণ, উত্তরদাতা মৌন।রাজনীতির আঙিনায় ‘মৌন’ শব্দটি শুনলে ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদি কথিত মৌন শব্দটি সামনে চলে আসে। তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংকে তিনি ‘মৌনমোহন’ বলে প্রায় প্রতিটি জনসভায় তীব্র কটাক্ষ করতেন।সময়ের কী আশ্চর্য পরিহাস, ‘বাগ্মী’ বলে যিনি পরিচিত, সেই নরেন্দ্র মোদি আজ কার্যত মৌন।
বিজেপি মৌন শব্দটি মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে কৌশলে জুড়ে দিয়েছিল ঠিকই,কিন্তু অনতি-অতীতের সংবাদপত্রের পৃষ্ঠা সাক্ষী দ্বিতীয় ইউপিএ জমানায় কয়লা কেলেঙ্কারি থেকে শুরু করে টুজি, আদর্শ ঘোটালা কিংবা কমনওয়েলথ কেলেঙ্কারি-বিরোধীদের তোলা অভিযোগের জবাব দিয়েছেন মনমোহন।কিন্তু অধুনা এক আশ্চর্য নীরবতা। অথচ বিরোধীদের তরফে যে সমস্ত অভিযোগ কেন্দ্রের বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক সময়ে উঠেছে, এক কথায় সেগুলি দ্ব্যর্থহীন সপাট অভিযোগ। ভারতবর্ষের মূলত গ্রামগঞ্জের যুবকেরা সেনা এবং আধা সেনাবাহিনীতে জওয়ানের চাকরি খোঁজেন।তারা অনিবার্যভাবে জানতে চান, কুড়ি সালে লাদাখের গালওয়ান উপত্যকায় ঠিক কী হয়েছিল, কেন চিনা সৈন্যের সঙ্গে সংঘর্ষে কুড়ি জন সেনা শহিদ হয়েছিলেন। ঊনিশের ফেব্রুয়ারীতে ঘটে যাওয়া পুলওয়ামা কাণ্ডের সত্য তারা জানতে চায়।ওই সময় জম্মু-কাশ্মীরের রাজ্যপালের পদে থাকা এবং সর্বোপরি বিজেপির সদস্য সত্যপাল মালিক পরে একাধিক সাক্ষাৎকারে পুলওয়ামা কাণ্ডের স্মৃতি উস্কে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী সেদিন তাকে ‘চুপ’ থাকার নির্দেশ দিয়েছিলেন।তার কাছে একই নির্দেশিকা এসেছিল জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভালের থেকেও। এমন গুরুতর অভিযোগের পরেও মোদি সরকার মৌন থেকেছে।
গ্রাম ছেড়ে যাওয়া যাক শহরে।শহুরে মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত তাদের কষ্টের উপার্জনের একটা অংশ শেয়ারে লগ্নি করেন।সেই লগ্নি তথা বাজার নিয়ন্ত্রণের ভার যাদের হাতে অর্থাৎ ভারতের মূলধনি বাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিয়োরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ বোর্ড অব ইন্ডিয়া (সেবি)-র চেয়ারপার্সন মাধবী পুরী বুচের সততা সম্পর্কে অধুনা জনমনে যে সংশয় তৈরি হয়েছে, তা নিঃসন্দেহে উদ্বেগের।লগ্নি তথা মূলধনের বাজার প্রবলভাবে বিশ্বাস-নির্ভর, সেই বিশ্বাসের ভিত নড়ে গেলে ওই বাজারের গোটা কাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ক্ষতিগ্রস্ত হয় সমগ্র অর্থনীতি।
আমেরিকার কর্পোরেট তথ্যানুসন্ধান সংস্থা হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ মাস কয়েক আগে সেবি-প্রধান ও তার স্বামী ধবল বুচের বিরুদ্ধে এক রিপোর্টে বিস্ফোরক অভিযোগ এনে দাবি করে,সেবি-র পর্যদ সদস্য ও চেয়ারপার্সন হওয়ার পরেও নিজের উপদেষ্টা সংস্থা আগোরা অ্যাডভাইজরিতে মাধবী নিজের অংশীদারিত্ব বহাল রেখেছিলেন।এহ বাহ্য,ওই ভারতীয় উপদেষ্টা সংস্থাটি বিভিন্ন দেশীয় শিল্পকে পরামর্শ দিয়ে আয় করে। অংশীদার হিসেবে সেই আয়ের শরিক হন মাধবী ও তার স্বামী ধবল।হিন্ডেনবার্গী রিসার্চের দাবি, যে বিদেশি ও অখ্যাত লগ্নিকারী সংস্থার মাধ্যমে ভারতের এক অতিকায় ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর নথিভুক্ত সংস্থাগুলিতে পুঁজি ঢেলে তাদের শেয়ারের দাম কৃত্রিমভাবে বাড়ানো হয়েছিল,তাতে বুচ দম্পতির লগ্নি ছিল।সেবি-প্রধানের বিরুদ্ধে নিরপেক্ষ অনুসন্ধান চালাতে রাজনৈতিক শিবির থেকে যৌথ সংসদীয় কমিটি গঠনের দাবি ওঠে।এই আবহে স্বয়ং মাধবীর মুখ থেকে বক্তব্য জানতে সম্প্রতি সংসদের পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটি (পিএসসি)-র বৈঠকে তাকে তলব করা হয়েছিল।কিন্তু সেবি-প্রধান ‘জরুরি কাজের কারণ’ দেখিয়ে বৈঠকে গরহাজির থাকেন।যার ফলে পিএসসির বৈঠকই মুলতবি হয়ে যায়।এত কিছুর পরে তবু সরকারের কর্তাব্যক্তিরা শুধু মৌন তা-ই নয়, উল্টে পিএসসি সদস্য বিজেপি সাংসদ নিশিকান্ত দুবে লোকসভার অধ্যক্ষকে চিঠি পাঠিয়ে এই মর্মে সওয়াল করেন যে, স্বয়ংশাসিত সংস্থার প্রধানকে নাকি পিএসসি বৈঠকে ডেকে পাঠানো যায় না।অথচ সরকার প্রচ্ছন্নে সেবি-প্রধানের পাশে না দাঁড়িয়ে বিরোধীদের দাবি মেনে নিলে সেটা কেবল অর্থনীতির স্বাস্থ্যের অনুকূল হতো না, শাসকদের মর্যাদা এবং বিশ্বাসযোগ্যতারও অনুকূল হতো।’সাঙাততন্ত্র’ নামক বস্তুটির কালো ছায়া তাদের সিংহাসনের উপর বিরাজমান বলেই সেই বিশ্বাসযোগ্যতা প্রতিষ্ঠা করা জরুরি ছিল।শেয়ার ধারকেরা যার কাছে প্রত্যয়ের কথা শুনতে চায়, সেই প্রধানমন্ত্রী একটা কথাও বলেননি।
বর্তমান সরকারের পরিচালকরা একান্ত বাধ্য না হলে সঙ্গত কাজ করেন না, যে কোনও প্রশ্ন বা আপত্তিকেই শত্রুতা হিসাবে গণ্য করেন ও উড়িয়ে দিতে চান, অথবা মৌন থাকেন। জ্ঞানী ব্যক্তিরা সেই কবেই বলে গেছেন, মৌনং সম্মতি লক্ষণম্!