বুলডোজার-তন্ত্র!!

 বুলডোজার-তন্ত্র!!
এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

দুর্ভাগ্য যে,আদালত বাধ্য না করা অবধি দেশের বা রাজ্যের সর্বোচ্চ প্রশাসকেরও সেই কর্তব্যের কথা মনে পড়ে না!অসৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে কোনওভাবেই নয়,রাষ্ট্র অবশ্যই তার তথ্য ও যুক্তি দিয়ে প্রতিবাদ করবে, প্রয়োজনে আইনানুগ প্রতিকারের ব্যবস্থা করবে, এরই নাম গণতন্ত্র।’যা করছি সেটাই ঠিক’- এই অবস্থান থেকে সরে এসে অপরের কথা শুনতে হয়, বিরোধী যুক্তি অনুধাবন করতে হয়। সেটাই গণতন্ত্রের দাবি।অথচ দুর্ভাগ্য এই গণতন্ত্রের যেখানে সর্বোচ্চ ন্যায়ালয়কে প্রশাসনের অধিকার স্মরণ করিয়ে দিতে হয়।এমনকী, সেই সূত্রে জারি করতে হয় সর্বভারতীয় স্তরে নির্দেশিকা। গতকাল সুপ্রিম কোর্টে বিচারপতি বিআর গাভাই এবং বিচারপতি কে ভি বিশ্বনাথনের বেঞ্চ অপরাধী বা অপরাধে অভিযুক্তের বাড়ি সরকারী তৎপরতায় বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়ার তীব্র সমালোচনা করে সখেদে মন্তব্য করেছে, প্রশাসন কখনোই বিচারক হয়ে বসতে পারে না। শাসকের বুলডোজার-তন্ত্রকে ঠিক এই ভাষায় সমালোচনা করে বলা হয়েছে, ‘এ এমন এক নৈরাজ্য, যেখানে ক্ষমতাই শেষ কথা।’
অপরাধীদের বাড়ি বুলডোজারে ভেঙে দেওয়ার ঘটনার জন্য কুখ্যাত ছিল মধ্যপ্রদেশের শিবরাজ সিংহ চৌহানের মুখ্যমন্ত্রিত্বের আমল।’বুলডোজার মামা’ আখ্যা পেয়েছিলেন শিবরাজ।উত্তরপ্রদেশেও এই ‘খ্যাতি’ অর্জন করেছেন যোগী আদিত্যনাথ।সে রাজ্যের গত বিধানসভা নির্বাচনে যোগীকে ‘বুলডোজার বাবা’ বলে তীব্র নিষাদে প্রচার চালিয়েছিল তার দল।এ হেন ‘বুলডোজার-বিচার’-এর বাড়বাড়ন্তের প্রেক্ষিতে বাড়ি ভাঙা নিয়ে নির্দিষ্ট নির্দেশিকা বেঁধে দেওয়ার আর্জি জানিয়ে মামলা হয়েছিল সুপ্রিম কোর্টে।বিচারপতিরা সেই মামলার রায় দিতে গিয়ে বলেছেন, কেউ অপরাধে অভিযুক্ত, স্রেফ এই যুক্তিতে প্রশাসনের নিজস্ব খেয়াল মতো তার বাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়াটা সম্পূর্ণ অসাংবিধানিক।৯৫ পাতার রায়ে বিচারপতিরা বলেছেন, ‘মহিলা, শিশু ও বয়স্কদের রাতারাতি গৃহহীন করে বুলডোজার চালিয়ে দেওয়া শিউরে ওঠার মতো দৃশ্য।’ বিচারপতিরা স্পষ্ট জানান, সংবিধানে এই ধরনের উদ্ধত আচরণ ও যথেচ্ছাচারের কোনও জায়গা নেই।
যদি তর্কের খাতিরে ধরে নেওয়া যায় যে, রাজ্য সরকারের আইনের লঙ্ঘন হয়েছে,আইনের পথেই তবে তার প্রতিবিধান কাম্য – পুলিশের এফআইআর-এ যদি তার শুরু, আদালতে মামলা হতে পারত তার পরবর্তী ন্যায্য পদক্ষেপ।তার বদলে গত কয়েক বছর ধরে একাধিক রাজ্য প্রশাসনের অস্ত্র হয়ে দাঁড়ায় বুলডোজার।দীপাবলির পরেও যেমন তার পিছু পিছু শীতের আগমন ঘটে, তেমনই ভারতের কিছু রাজ্যে বিশেষত সংখ্যালঘুর বাড়িতে পুলিশ এলেই পশ্চাতে বুলডোজারেরও আগমন ঘটে। বুলডোজারের বেপরোয়া দাপট উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, কাশ্মীরে তো বটেই,এমনকী দিল্লীতেও শাসকের পছন্দের অস্ত্র হয়ে ওঠে।এই সব রাজ্যে ক্রমে বুলডোজার হয়ে ওঠে সরকারী ‘ন্যায়’ এবং ‘পরাক্রম’-এর প্রতীক এবং হাতিয়ার।সরকারী জমি দখল করে নির্মাণকাজ নিশ্চয়ই বেআইনি,কিন্তু তার উত্তর যখন বেছে বেছে গোমাংস-চিহ্নিত বাড়িগুলি বুলডোজারে গুঁড়িয়ে যায় তখন বুঝতে ভুল হয় না, এ আসলে কীসের জবাব, কীসের শাস্তি।বিচারপতিদ্বয় জানিয়েছেন, আইনের শাসন হলো রাষ্ট্রক্ষমতার বুলডোজার যথেষ্ট ব্যবহারের হাত থেকে নাগরিকদের রক্ষাকবচ। গণতন্ত্র এবং সুশাসনের জন্যও তা জরুরি।
সর্বোচ্চ আদালত যেভাবে প্রশাসনকে তার গণ্ডি মনে করিয়ে দিয়েছে, তার প্রভাব সুদূরপ্রসারী নিঃসন্দেহে। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে অভিযুক্তের ঘরবাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়া কোনও সভ্য দেশেরই পরিচায়ক নয়।এই বুলডোজারের চালিকাশক্তিটি রাজনীতি। এক বিশেষ গোত্রের রাজনীতি, যেখানে নেতা জনগণের কাছে নিজের এই ভাবমূর্তি তৈরি করতে চান যে, তার পথে কোনও বাধাই তিনি সহ্য করবেন না।বিরুদ্ধ মতের উপরে বুলডোজার চালিয়ে দেওয়ার বাসনা বহু বছর ধরেই রাজনৈতিক ক্ষমতার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে উঠেছে ভারতে।শিবরাজ সিং চৌহান বা আদিত্যনাথের কৃতিত্ব, কথাটিকে রূপকার্থে ব্যবহার না করে তারা এটির আক্ষরিক প্রয়োগ করেছেন। রাষ্ট্র যাকে ‘উন্নয়ন’ এর শত্রু জ্ঞান করবে, তা রাজনৈতিক মতবাদের কারণেই হোক বা ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে, সেই বিরুদ্ধ,প্রতিস্পর্ধী মতকে বুলডোজারের নিচে পিষে দেওয়ার মাধ্যমে যে বিজয়রথ অগ্রসর হতে পারে না, সুপ্রিম কোর্ট তার মূল্যবান রায়ের মাধ্যমে সেটাই বুঝিয়ে দিয়েছে।কেউ যদি দোষী হয়, কেউ যদি অপরাধী হয়,তা প্রমাণ হবে আদালতে।তাকে সাজার নিদান দিতে পারে একমাত্র আদালত।সরকার বা প্রশাসনের কাজ সেটা নয়।

Dainik Digital

Dainik Digital

Leave a Reply

Your email address will not be published.