মণিপুর লইয়া ভাবনা!!
ফের আফস্পা, ফের আগুন, ফের অশান্ত মণিপুর।উত্তর পূর্বাঞ্চলে শান্তি ফিরাইবার যে দাবি এতদিন করিয়া আসিতেছে কেন্দ্রের মোদি নেতৃত্বাধীন জোট সরকার সেই দাবি বুঝি আর টিকিতেছে না।মণিপুর আবার জাতিদাঙ্গার আগুনে ধিকিধিকি জ্বলিতেছে। একদিকে অপহৃত ছয় শিশু মহিলার ছিন্নবিচ্ছিন্ন মৃতদেহ আর অন্যদিকে নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে ‘ভুয়া’ সংঘর্ষে মৃত ছয় যুবকের দেহ। মৃতদেহের মিছিলের পিছনে রণং দেহি দুই সম্প্রদায়ের মানুষ।পথে নামিয়া আসিয়াছেন একদিকে মেইতেই জনগোষ্ঠীর মানুষ, অন্যদিকে কুকি সম্প্রদায়ের মানুষ।
মণিপুরে কুকি নাগা সংঘর্ষের এক ভয়ানক কাল বিগত হইয়াছে।নাগা চুক্তি সম্পাদনের পর ধীরে ধীরে এই সংঘাত বন্ধ হয়,কিন্তু সাম্প্রতিককালের মণিপুরে নয়া অশান্তি ঘনাইয়া আনে মেইতেই – কুকি সাম্প্রদায়িক সংঘাত।এই সকল ছোট বড় সকল সম্প্রদায়কে লইয়াই আগাইয়া চলিতেছিল মণিপুর।সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা করিয়াই উত্তর পূর্বের সকল রাজ্যগুলির মধ্যে একটি উজ্জ্বলতম স্থান দখল করিয়া লইয়াছিল এই রাজ্যটি।কিন্তু গত কয়েক বৎসরে তাহার গরিমা অনেকটাই ম্লান হইয়া পড়িয়াছে।পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে চলিয়া গেছে যে, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নানান সময়ে পদত্যাগের ইচ্ছাও প্রকাশ করিয়াছেন।
দায় স্বীকার করিয়া পদত্যাগে তাহাদের যেন কোনও কুণ্ঠা বা আপত্তি নাই।আবার বিজেপি নেতৃত্বাধীন এই সরকারের পদত্যাগের পর বিরোধীরা সরকার গড়িলেই যে সমস্যা কমিবে, আগুন নিভিবে এমন নিশ্চয়তা কেহই দিতে পারে না। সাম্প্রদায়িকতার বিষ গভীরে প্রবেশ করিয়া গিয়াছে। যদিও গত সাত তারিখে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক ফের মণিপুরের পাঁচ জেলায় ছয় থানায় আফস্পা জারির পর মণিপুর কংগ্রেসের নেতারা বলিয়াছেন,বিজেপির সরকার গড়ার পর এই রাজ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি চূর্ণবিচূর্ণ হইয়াছে। পারস্পরিক শ্রদ্ধা,বিশ্বাস ভাঙ্গিয়া দেওয়া হইয়াছে। এতদিনকার পরম্পরা বিনষ্ট করিয়া দেওয়া হইয়াছে।
মণিপুরের সর্বশেষ যে পরিস্থিতি তাহাতে মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ বুঝি সময়ের অপেক্ষা।নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে তথাকথিত সংঘর্ষের ঘটনায় আট কুকি যুবকের মৃত্যু ঘটে।তাহাদের দেহ শিলচর মেডিক্যাল কলেজের মর্গে আনা হয়।দেহ লইয়া আসাম পুলিশের সহিত একপ্রস্থ সংঘর্ষ ঘটে। পরিজনেরা দেহ নিতে চাহিলে আসাম পুলিশ তা হস্তান্তরে অস্বীকার করে।দেহ সেনা ঘাঁটিতে পৌঁছাইয়া দেওয়া হয়।সেনা কপ্টারে দেহ চুরাচান্দপুর লইয়া আসিয়া পরিজনদের হাতে দিয়া দেওয়া হয়।অন্যদিকে মেইতেই সম্প্রদায়ের ছয় শিশু,মহিলাকে অপহরণের পর হত্যার পর তাহাদের দেহ নদীর জলে ভাসাইয়া দেওয়া হয়।সেই দেহও ক্রমান্বয়ে হাসপাতালের মর্গ হইতে ইম্ফলে পাঠাইয়া দেওয়া হইয়াছে।
একদিকে চুরাচান্দপুর, আর একদিকে ইম্ফল- দুই শহরে শোক আর উত্তেজনা মাত্রা ছাড়াইয়াছে।ছয় শিশু-মহিলার মৃত্যুর খবরে শনিবার ইম্ফল শহর অগ্নিকাণ্ডে পরিণত হয়। মুখ্যমন্ত্রীকে তাহার সরকারী আবাস হইতে সরাইয়া লওয়া হইয়াছে,নিরাপত্তার কারণে। বিধায়ক,মন্ত্রীদের বাড়িঘরে হামলা,অগ্নিসংযোগই শুধু নহে, তাহাদের ডাকাইয়া লইয়া মন্ত্রিত্ব বা বিধানসভার সদস্যপদ হইতে পদত্যাগের জন্য চাপ সৃষ্টি করা হয়। জানা যায় পাঁচ মন্ত্রী, বিধানসভার অধ্যক্ষ সহ বিজেপির দশের অধিক সদস্য পদত্যাগে তাহাদের ইচ্ছা ব্যক্ত করিয়াছেন। অন্যদিকে বিজেপি জোটের শরিক এনপিপি তাহাদের সমর্থন প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত জানাইয়া দিয়াছে।
সব মিলিয়া মণিপুর এখন এক অশান্ত ভূমিখণ্ড।পাহাড় বা সমতল সর্বত্র হৃদয়বিদারক দৃশ্য।আর তাহার পশ্চাতে মানুষের ক্ষোভ, রাগের আগুন ধিকিধিকি জ্বলিতেছে আর সুযোগ পাইলেই প্রকাশ্য রাস্তায়, সরকারী বাড়ি, মন্ত্রীমাল্লাদের আবাসে আসিয়া আছড়াইয়া পড়িতেছে।পরিণতি যে ভয়াবহ হইতে চলিয়াছে তাহা শনিবার সন্ধ্যায় আঁচ করিয়াছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। শান্তি বজায়ের আহ্বান রাখিয়া বিবৃতি দেয়।সন্ধ্যায় প্রশাসন বেশকিছু জেলায় কাফু জারি করিয়াছে।কারণ দুইটি শহরে যদি মৃতদেহ লইয়া মিছিল পথে নামে তাহা হইলে পরিস্থিতি আর পুলিশের নিয়ন্ত্রণে রাখা যাইবে না।আফম্পা যে দিল্লীর জন্য হিতে বিপরীত হইতেছে তাহা যদি কেন্দ্রীয় কর্তারা বুঝিতে পারেন তাহা হইলে মণিপুরের মঙ্গল হইতে পারে।এই সময়ে সবার আগে দরকার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ফিরাইয়া আনা। মানুষের মনে বিশ্বাস জাগাইয়া তুলিতে হইলে যা যা করণীয় সকলই করা দরকার।কিন্তু করিবে কে? মণিপুরে জাতিদাঙ্গা শুরুর পর্যায় হইতেই কেন্দ্রীয় সরকারের যে উন্নাসিকতা দেখা গিয়াছে তাহা অবিশ্বাস্য। কেবল উত্তর পূর্বাঞ্চল বলিয়াই কি এই
উন্নাসিকতা?