শিক্ষক মাত্রই সফ্ট টার্গেট!!
সম্প্রতি তেলিয়ামুড়ার কৃষ্ণপুরে এক শিক্ষক স্কুল। চলাকালীন সময়ে স্কুলের মধ্যেই নির্মমভাবে প্রহৃত হয়েছেন।এই চিত্র সামাজিক মাধ্যমে গোটা রাজ্যেই ছড়িয়েছে।গোটা রাজ্যের মানুষ তা দেখেছে।কিন্তু কোনও প্রতিক্রিয়া নেই। একজন শিক্ষককে স্কুল চত্বরে বেধড়ক পিটিয়েছে তারই ছাত্রছাত্রীরা।সঙ্গে অভিভাবকরা,আর স্কুলের অন্যান্য শিক্ষক শিক্ষিকা তা প্রত্যক্ষ করেছে অন্যদের মতো।কেউই এদিয়ে আসেনি তাকে বাঁচাতে।পরবর্তীতে পুলিশ এসে তাকে উদ্ধার করেছে।এই ঘটনার প্রায় তিন চার মাস আগে উদয়পুরে এক শিক্ষককেও পিটিয়ে মারা হয়েছে বাড়িতে ডেকে নিয়ে গিয়ে।সাম্প্রতিককালে শিক্ষক প্রহৃত হবার ওই ২টি ঘটনাই প্রমাণ করে যে, সমাজের কতটা নৈতিক স্খলন হয়েছে।যেভাবে মানুষ আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে আইন নিজের হাতে নিয়ে নিজেই বিচার করছে তা ভবিষ্যতের জন্য অশনি সংকেত বয়ে আনতে চলেছে বলে মনে করছেন শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষজন। খবরে প্রকাশ,কৃষ্ণপুরের একটি বিদ্যালয়ে যাকে গণপ্রহার করা হয়েছে তিনি ওই বিদ্যালয়ের কম্পিউটার ইনস্ট্রাকটর।তার চাকরি নিয়মিত নয়।তার অপরাধ কী ছিল তা তদন্তসাপেক্ষ। তার বিরুদ্ধে কী অভিযোগ ছিল তাও জানা যায়নি।বলা হচ্ছে,ছাত্রীদের তিনি কটুক্তি করেছেন।আবার কম্পিউটার শিক্ষক বলেছেন, তাকে ফাঁসানো হয়েছে।এই ঘটনা সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পর মন্ত্রী বিকাশ দেববর্মা গিয়ে স্কুলে বৈঠক করেছেন।তিনি বলেন,এই ঘটনা হবার ছিল না।এরপর পুলিশ ২ অভিভাবকের বিরুদ্ধে মামলা নিয়েছে। শিক্ষকের বিরুদ্ধে যদি অভিযোগ থাকে তাহলে কি তাকে এভাবে গণপিটুনি দেওয়া ঠিক হয়েছে? শিক্ষককে ঝাঁটা,লাঠি হাতে নিয়ে ছাত্রছাত্রীরা পিটিয়েছে, অভিভাবকরা পিটিয়েছে। দরজা ভেঙে ক্লাসরুমের ভেতরে গিয়ে পিটিয়েছে। সভ্য সমাজে ওই ধরনের বর্বরতা কী মানা যায়?আইন কি এভাবে হাতে নেওয়া যায়?তাও আবার কোনও শিক্ষাঙ্গনে?
শিক্ষকদের একটা সময় শ্রদ্ধার আসনে রাখা হতো। জাতির মেরুদণ্ড বলা হতো। কিন্তু বর্তমানে শিক্ষকদের মেরুদণ্ডটাই ভেঙে দিয়েছে সমাজ।একজন শিক্ষক এখন আর শুধু শিক্ষক নন। তিনি এখন একেকজন কেরাণি,ম্যানেজার, হিসাবরক্ষক, সমীক্ষক, ভোটের কাজ নির্বাহকারী, মিড ডে মিল পরিচালক, হেল্থ অ্যাম্বাসেডরের ডিউটি,আইএনও’র ডিউটি সহ নানা প্রাত্যহিক কাজ শিক্ষকের কাজের মধ্যে পড়ে।এখন বিদ্যালয়ে শুধু বিদ্যাপাঠ নেই।আলয় ঠিক রয়েছে।বরং আলয়ের উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি ঘটছে। এই করতে গিয়ে আরও পাঁচটা চাকরির মতো শিক্ষকরাও বর্তমানে ‘চাকরি’ টাই করছেন।আগে শিক্ষকদের চাকরিকে চাকরি বলা হতো না।শিক্ষকদের সমাজের বিশিষ্ট নাগরিক হিসাবে তকমা দেওয়া হতো। মাস্টারমশাইদের সম্মানের চোখে দেখতো সমাজ। শিক্ষকের চাকরিতে স্খলন হতে হতে এখন ছাত্রছাত্রীদের চোখেও শিক্ষক শুধু একজন দেওয়া নেওয়ার পাত্র হয়ে গেছে।ফল যা হবার তাই হচ্ছে।যে ছাত্রছাত্রীরা কৃষ্ণপুরের এই শিক্ষককে পিটিয়েছে তারা প্রায় প্রত্যেকেই ওই শিক্ষকের পুত্র, কন্যাসম।তাদের হাতে ঝাঁটাপেটা খেতে হয়েছে তাকে।এই অপমান সমাজ কীভাবে সইবে?
উদয়পুরে এক শিক্ষককে এক ছাত্রীর বাড়িতে ডেকে নিয়ে গিয়ে মারা হয়েছে।পরে তার মৃত্যু হয়েছে।মুখ্যমন্ত্রী পর্যন্ত নিহত শিক্ষকের বাড়িতে গেছেন। কিন্তু সম্প্রতি জানা গেছে, অভিযুক্তরা জামিন পেয়ে গেছে দুর্বল পুলিশি তদন্তের কারণে।
শিক্ষকরা আক্রান্ত হচ্ছে, মার খাচ্ছে মরছে,কিন্তু শিক্ষক সমাজ জাগছে না।কোনও প্রতিবাদ নেই।ভয়ে সব সিঁটিয়ে রয়েছে।অথচ ত্রিপুরাতে সবচেয়ে বেশি কর্মচারী শিক্ষা দপ্তরে। সবচেয়ে বেশি কর্মচারী মানেই শিক্ষকরা। অথচ একজন শিক্ষকের কোনও প্রতিবাদ নেই।রাজপথে নেমে আন্দোলন নেই।শিক্ষক সমাজ আজ শুধুই মুক, বধির।শিক্ষকরা এখন সকলেরই সফ্ট টার্গেট।শিক্ষা দপ্তরের কোনও হেলদোল নেই।কোন প্রতিক্রিয়া নেই। একজন শিক্ষক দিনদুপুরে প্রকাশ্যে স্কুল চত্বরে ঝাঁটাপেটা খাচ্ছে,শিক্ষা দপ্তরের কোনও বিবৃতি নেই। কোন শিক্ষক সংগঠনের বিবৃতি নেই।প্রতিবাদ নেই। তিনি কী অন্যায় করেছেন, কেউ জানে না।
অন্যায় তিনি করলে তার জন্য বিচারব্যবস্থা রয়েছে। আইন রয়েছে,আদালত রয়েছে।কিন্তু এভাবে স্কুল চত্বরে একজন শিক্ষককে প্রায় উলঙ্গ করে ঝাঁটাপেটা করেছে তারই ছাত্রছাত্রীরা, তাদের অভিভাবকরা এ কোন্ ধরনের আইন?এক কোন্ সমাজে আমরা বাস করছি।শিক্ষক সমাজ আর কবে জাগবে?