মিডিয়ার স্বাধীনতা।।

 মিডিয়ার স্বাধীনতা।।
এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

গত বছরের মে মাসে ইউরোপীয় ইউনিয়ন কাউন্সিলে গৃহীত হয় গত বছরের মে মাসে ইউরোপীয় ই যা বাস্তবে লাগু হওয়ার কথা আগামী ৮ আগষ্ট থেকে। সাম্প্রতিক বেশ কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন শব্দের পুনরাবৃত্তির সঙ্গে মানুষের আয়- ব্যয়ের, বিনিয়োগের, এমনকী শেয়ার বাজারে উত্থান-পতনের সম্পর্ক। হয়েছে। মানুষ যাতে বিপথে চালিত না হন তার জন্য সংবাদ পরিবেশনকারী সংস্থাকে যেমন অনেক বিধিনিষেধ মানতে হয়, তেমনই তাদের স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকার রক্ষার্থে আইন প্রণয়ন গণতন্ত্রে সরকারের অবশ্যকর্তব্য।
যে দেশ স্বৈরতন্ত্রী শাসনের অধীন, সেখানকার মানুষ সরকারী খবরের সত্যতা নিয়ে বরাবরই সন্দিহান থাকেন। এই দেশগুলিতে সংবাদসংস্থা সম্পূর্ণভাবে সরকার-নিয়ন্ত্রিত। ফলে সে সব দেশে মিডিয়া মিথ্যার বেসাতি করলেও মানুষের সিদ্ধান্তকে তা সামান্যই প্রভাবিত করে। বরং, স্বৈরাচারী শাসকের সংবাদমাধ্যমে যেহেতু শুধু সরকারের ঢাক পেটানোর সংবাদই প্রকাশিত হয়, মানুষের ক্ষোভের কথা স্থান পায় না, ফলে মানুষ আসলে কী ভাবছেন, শাসকদের কানে সে খবরের বেশির ভাগটাই পৌঁছয় না। কোনও এক সময়ে বড় আন্দোলন তৈরি হলে সরকার তার মোকাবিলায় প্রস্তুত হতে পারে না। আর অবাধ নির্বাচন যদি কোনওভাবে ঘটে যায়, তা হলে তো পটপরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী।
রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট সংবাদ অনেক বেশি ক্ষতি করে গণতান্ত্রিক দেশে, যেখানে মানুষ মনে করেন যে, কম-বেশি সঠিক সংবাদই প্রকাশিত হচ্ছে। সংবাদ আদপে তথ্য, এবং তথ্যই হলো আজকের পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় সম্পদ। মানুষ বিভিন্ন ভাবে সেই তথ্য বিশ্লেষণ করে এককভাবে বা গোষ্ঠীবদ্ধ ভাবে বিভিন্ন সিদ্ধান্তে উপনীত হন। ফলে সংবাদের গুণমান যদি অন্য কোথাও থেকে নিয়ন্ত্রিত হয়, তা হলে গণতান্ত্রিক দেশে আর্থিক ও রাজনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি হবে এমন আশঙ্কা থাকে।
এ দেশে নিরপেক্ষ-নির্ভীক তথ্য আদান-প্রদানের স্বরূপটি কেমন, নতুন বছরের শুরুতেই এক সাংবাদিকের নিখোঁজ হয়ে যাওয়া এবং দু’দিন পরে তার মৃতদেহ খুঁজে পাওয়ার সংবাদটি হতে পারে তার এক মর্মন্তুদ খণ্ডচিত্র। অমানুষিক বীভৎসতায় ছত্তিশগড়ের সাংবাদিক মুকেশ চন্দ্রকরের মৃত্যু তথা হত্যা এই ঘটনার পূর্বাপর বৃত্তান্ত একটি অসুস্থ রাষ্ট্রব্যবস্থাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। ছত্তিশগড়ের সাংবাদিক মুকেশ তার ইউটিউব চ্যানেলে সেই সব সংবাদ তুলে ধরতেন যা স্থানীয় ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও অনেক ক্ষেত্রে প্রশাসনেরও প্রবল অস্বস্তির কারণ। সম্প্রতি ১২০ কোটির সড়ক নির্মাণ প্রকল্পে যুক্ত এক ঠিকাদার – সংস্থার আর্থিক দুর্নীতি নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করেছিলেন তিনি। সেই খবরের জেরে রাজ্যের বিজেপি সরকার সংস্থাটির বিরুদ্ধে পদক্ষেপও করে। তার পরেই নিখোঁজ হন মুকেশ, দু’দিন পরে তার মৃতদেহ উদ্ধার হয় সেই ঠিকাদার সংস্থার নির্মাণ প্রকল্পের একটি ট্যাঙ্ক থেকে। আটাশ বছরের তরুণ সাংবাদিককে যে নিষ্ঠুরতায় হত্যা করা হয়েছে, তা যেকোনও সভ্য দেশের কলঙ্ক।
মুকেশ চন্দ্রকরের মৃত্যুর পর যা হয়েছে যেমন কয়েকজন অভিযুক্ত ধরা পড়েছে, ছত্তিশগড় সরকার কড়া শাস্তি নিশ্চিত করার অঙ্গীকার করেছে। এই সবই পুরনো চালচিত্র, বহুব্যবহারে ক্লিষ্ট। উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র বিহার, ছত্তিশগড়, কর্নাটক – শুধু ঘটনাস্থল বদলে যায়, বদলে যায় সাংবাদিকদের নাম। করুণ মিশ্র, রঞ্জন রাজদেব, সন্দীপ শর্মা, শুভম ত্রিপাঠী, শশীকান্ত ওয়ারিশে, গৌরী লঙ্কেশ, নবতম সংযোজন মুকেশ চন্দ্রকর। এরা সরকারের উগ্র নীতি ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে খবর করেছিলেন, কিংবা বালি ও জমি মাফিয়া, অসাধু নির্মাণ বা ঠিকাদার সংস্থার হাতে পরিবেশ ও প্রকৃতির মুছে যাওয়া নিয়ে। প্রতিটি ঘটনার গভীরে রয়েছে রাজনীতি ও ব্যবসার অশুভ আঁতাঁত, যার বলি হচ্ছেন ভারতীয় সাংবাদিকরা। যে প্রশাসন সাংবাদিক-হত্যায় নিন্দা করছে, তারই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কল্যাণহস্তে পুষ্ট হচ্ছে অসাধু ব্যবসাচক্র – এই সত্য অস্বীকারের কোনও উপায় নেই।
মুক্ত,স্বাধীনচেতা, প্রশ্নবাচী সংবাদমাধ্যমের সামনে রাষ্ট্রক্ষমতার ধারক ও বাহকদের অস্বস্তি কেবল সঙ্গত নয়, কার্যত অনিবার্য। সাংবাদিকের ভূমিকা অতন্দ্র প্রহরীর। সরকারী কর্তা ও কর্মীরা তাদের কর্তব্য যথাযথভাবে সম্পাদন করছেন কি না, সেদিকে কঠোর ও তীক্ষ্ণ নজর রাখা এবং কোনও বিষয়ে ক্ষমতাবানদের আচরণে বিচ্যুতি ঘটলে তার স্বরূপ উদঘাটন করাই ‘ফোর্থ এস্টেট’-এর স্বধর্ম। সংবাদমাধ্যম যাতে তার এই প্রাথমিক কাজটি স্বাধীন এবং নির্ভীকভাবে সম্পাদন করতে পারে, তা নিশ্চিত করাই একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের দায়িত্ব, তার গণতান্ত্রিকতার অন্যতম প্রধান শর্ত।

Dainik Digital

Dainik Digital

Leave a Reply

Your email address will not be published.