ট্রাম্পের ট্যারিফোনমিক্স।।

 ট্রাম্পের ট্যারিফোনমিক্স।।
এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

ভারতের রাজনীতিতে চর্চার ভরকেন্দ্রে তেমনই ডোনাল্ড ট্রাম্পের অঘোষিত বাণিজ্যযুদ্ধ। বিদেশি পণ্যের উপর নিরবচ্ছিন্ন আমদানি শুল্কের হুঁশিয়ারি দিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট যদি ভেবে থাকেন, এমত পদক্ষেপের মধ্যে দিয়ে তিনি গোটা দুনিয়ার বাদশা হয়ে উঠবেন তা নিছকই দিবাস্বপ্ন, নিষ্ফল ব্যাকুলতা। এক মাস আগে সে দেশের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট পদে শপথ নেওয়া ইস্তক প্রতিদিন, ট্রাম্পের প্রতিটি পদক্ষেপ বুঝিয়ে দিচ্ছে, আন্তর্জাতিক সহযোগিতায় তিনি বিশ্বাস করেন না, তার কাছে এই বিপুলা পৃথিবী যেন রশিতে ঘের মুষ্টিযুদ্ধের এক অদৃশ্য বর্গক্ষেত্র। মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন সংক্ষেপে ‘মাগা’ স্লোগানে ভর করে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বৈতরণী পার করেছেন ট্রাম্প। কিন্তু তার উগ্র রাষ্ট্রবাদী পদক্ষেপ শেষ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক আঙিনায় যুক্তরাষ্ট্রকে এক নিঃসঙ্গ রাষ্ট্রে পরিণত করলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। মার্কিন প্রেসিডেন্ট যেভাবে শুল্ক -যুদ্ধের শিঙা ফুঁকেছেন, তাতে বিশ্ব বাণিজ্যের ভারসাম উলটপালট হয়ে যেতে পারে।
ট্রাম্পের কাছে এটি একটি কুশলী অস্ত্র হতে পারে, তবে এই অস্ত্রের প্রভাব আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতিতে সুদূরপ্রসারী হতে বাধ্য চিন আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্ক হ্রাস করে এশিয়ার দেশগুলির সঙ্গে বাণিজ্যের বাঁধন মজবুত করবে সেটাই স্বাভাবিক। শুল্কের হুঁশিয়ারির পাশাপাশি ট্রাম্পের পরিবেশ দূষণরোধের অসহযোগিতা আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ঘোষণায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রগুলি ইতিমধ্যে আমেরিকার থেকে দূরে হাঁটার কথা ভাবছে। বাকি রইলো ভারতের কথা। এখনও ট্রাম্প ভারতের উপরে বিশেষ আমদানি শুল্ক বসাননি বটে, কিন্তু হুমকি জারি রেখেছেন। দ্বিতীয় দফায় প্রেসিডেন্ট হয়ে এই প্রথম নিজের ‘পুরনে বন্ধু’ নরেন্দ্র মোদির মার্কিন সফর সাঙ্গ হতেই, ভারতের ভোটারদের বুথমুখী করতে আমেরিকা যে ১৮২ কোটি টাকা (২ কোটি ১০ লক্ষ ডলার) অনুদান দিতো, ধনকুবের ইলন মাস্কের সুপারিশের ভিত্তিতে সেটি বাতিলের কথা ঘোষিত হয়েছে। ফলে পরিস্থিতি হাতছাড়া হলে ভারতও চিন আর রাশিয়ার দিকে ঝুঁকবে, ঝুঁকবেই মোটকথা ভূ-রাজনীতিতে এক ধরনের অনিশ্চয়তার বাতাবরণ তৈরি হবে। ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের এই পদক্ষেপ তার দেশে মুদ্রাস্ফীতি বাড়াবে। অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার নিম্নমুখী হবে। যার প্রতিফলন ঘটবে মার্কিন কর্মী-শ্রমিকদের জীবনে।
ট্রাম্প যে এ কথা জানেন না তা নয়। সম্ভবত তাকে ভাবিয়ে তুলেছে নিজ দেশের বাণিজ্য ঘাটতি। তিনি নিজে যেহেতু পেশায় বণিক, তাই হয়তো ভাবছেন যে, বাণিজ্যিক ঘাটতিতে দেশের ক্ষতি। যেহেতু তার নির্বাচনি প্রতিশ্রুতি ছিল কোনও অবস্থাতেই তিনি মার্কিন নাগরিকদের উপর করের বোঝা বাড়াবেন না, ফলে প্রত্যক্ষ কর বাড়িয়ে এই ঘাটতি পুরণ সম্ভব নয়। প্রসঙ্গত, একটি অর্থবর্ষে কোনও দেশের রপ্তানির চেয়ে আমদানির বহর বেশি হলে, বাড়তি ওই অর্থকে বাণিজ্য ঘাটতি হিসাবে ধরা হয়। কিন্তু জাতীয় আয়ের পরিসংখ্যান নিয়ে সামান্য হিসাব করলেই নির্ধারণ করা যায় যে, দেশে যদি আমদানির অর্থমূল্য রপ্তানির চেয়ে বেশি হয়, তার অর্থ, দেশের সরকার বা নাগরিকরা আয় বা কর সংগ্রহের তুলনায় বেশি ব্যয় করছেন। যার ফল দেশে সঞ্চয়ের অভাব। পরিসংখ্যান বলছে, আমেরিকার নাগরিকদের ব্যক্তিগত সঞ্চয়ের হার কর প্রদানের পর অবশিষ্ট আয়ের ৩.৮ শতাংশ। ২০১৫ সালের পর থেকেই এই সঞ্চয়ের হার নিম্নগামী। আমেরিকাতে ২০২৪-এ সরকারী বাজেট ঘাটতির হার জাতীয় আয়ের ৬.৩ শতাংশ, যা গত পঞ্চাশ বছরের গড় বাজেট ঘাটতির প্রায় দ্বিগুণ। জাতীয় সঞ্চয়ের এই মৌলিক খামতির সমস্যা বিবেচনা না করে, ট্রাম্প আমদানি শুল্ক বাড়িয়ে চটজলদি এক ঢিলে বহু পাখি শিকার করার কথা ভাবছেন। তিনি মনে করছেন, আমদানি শুল্ক বসলে দেশের শিল্প চাঙ্গা হবে। কিন্তু শুল্ক বাড়লে আমদানি করা জিনিসের দামও বাড়বে। সেই কারণে লোকে বিদেশি পণ্য থেকে মুখ ফেরালে শুল্ক বাবদ রাজস্ব কমবে। যে দেশগুলির উপরে শুল্কারোপ করা হবে, তারাও আমেরিকা থেকে রপ্তানি পণ্যের উপরে পাল্টা চড়া শুল্ক চাপাতে শুরু করবে, যেমন ইতিমধ্যেই ভাবছে আমেরিকার সনাতন দুই বাণিজ্য- মিত্র কানাডা এবং মেক্সিকো। একদলীয় শাসকের দেশ চিন মার্কিন পণ্যে পাল্টা শুল্ক আরোপ করেই ফেলেছে। এ সবের প্রত্যক্ষ প্রভাব আমেরিকার রপ্তানি শিল্পক্ষেত্রে পড়তে বাধ্য। এই বাণিজ্যিক যুদ্ধে কে জিতবে বলা কঠিন। আমদানি শুল্ক বাড়িয়ে অর্থনীতিতে চাঙ্গা করার এই কৌশলকে অর্থশাস্ত্রীরা বলেন ‘ট্যারিফোনমিক্স’।ভূ-রাজনীতিতে ক্রমশ একাকী, নিঃসঙ্গ হয়ে পড়লে ট্রাম্পের পক্ষে কতটা কার্যকরী হবে ট্যারিফোনমিক্স?

Dainik Digital

Dainik Digital

Leave a Reply

Your email address will not be published.