অমৃতধারার অসুখবিসুখ।।

 অমৃতধারার অসুখবিসুখ।।
এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

শেষ হইয়াও শেষ হইল না মহাকুম্ভ। বিশ্বের সর্ববৃহৎ জনবহুল ধর্মীয় এবং আধ্যাত্মিক অনুষ্ঠানের আসর মহাকুম্ভ। প্রয়াগরাজে গঙ্গা,যমুনা ও অন্ত:সলিলা সরস্বতীর সঙ্গমস্থলে শিবরাত্রির দিন শেষ অবগাহনের মধ্য দিয়া সমাপ্তি ঘটিল ৪৫ দিনব্যাপী মহাকুম্ভের। মঙ্গলবার রাত দুইটা হইতে শুরু হইয়াছিল শেষ তিথির স্নান,শাহি স্নান। বুধবার দিনাবসানের মধ্য দিয়া মহাকুম্ভের মেলা শেষ হইয়াছে। শেষদিন সঙ্গমে পুণ্যার্থীদের ওপর আকাশ হইতে পুষ্প বর্ষিত হয়। এত দীর্ঘসময় ধরিয়া এত বিশাল সংখ্যক মানুষের উপস্থিতিতে এমন ধর্মীয় আচার ভারত আর কখনও দেখে নাই।
মহাকুম্ভ শেষ হইলেও ভবিষ্যতের জন্য এই আয়োজনস্থল পরিবেশগত বিপর্যয়ের মুখে পতিত হইয়াছে- এই সতর্কবাণী উচ্চারণ করিয়াছে নানান পরিবেশ সংগঠন।গ্রিন ট্রাইবুনাল সর্বাগ্রে জল দূষণের কথা বলিয়াছে। রাজনীতিক এবং উৎসবের পরিচালকেরা এই সকল সতর্কতাকে আমল না দিলেও পুণ্যার্থীগণের অভিজ্ঞতা এবং প্রচারিত ছবি দেখিয়া মানুষ জানিয়েছেন ত্রিবেণী সঙ্গম এবং তাহার চতু:পার্শ্বের পরিবেশ বিষাইয়া গিয়াছে। দেশের অন্যতম পরিবেশ আন্দোলনকর্মী সোনম ওয়াংচুক বলিয়াছেন, পরিবেশের যে ক্ষতি হইয়া গিয়াছে, তাহাতে ১৪৪ বছর পর যদি আরও একটি মহাকুম্ভের আয়োজন হয় তাহা হইলে পুণ্যার্থীদের সঙ্গমে আসিয়া জলের পরিবর্তে বালিয়াড়িতে ডুব দিতে হইবে।
মহাকুম্ভ শুরু হইয়াছিল ১৩ জানুয়ারী, পৌষপূর্ণিমার পুণ্যস্নানের মধ্য দিয়া। পরদিন ১৪ জানুয়ারী ছিল মকরসংক্রান্তি। তার পরবর্তী পুণ্যতিথি ছিল ২৯ জানুয়ারীর মৌনী অমাবস্যা, সেই দিন মহাকুম্ভে ঘটে পদপিষ্ট হইয়া মৃত্যুর মতন দুঃখজনক ঘটনা। সরকারী তথ্যে পদপিষ্ট হইয়া মৃত্যু হইয়াছে ত্রিশজনের।কিন্তু এই ঘটনাতেও পুণ্যার্থীর স্রোত বিন্দুমাত্র কমে নাই। বসন্তপঞ্চমী (৩ ফেব্রুয়ারী), মাঘীপূর্ণিমা (১২ ফেব্রুয়ারী) এবং ২৬ ফেব্রুয়ারীর শিবরাত্রির শাহিস্নান উপলক্ষে কোটি কোটি মানুষ প্রয়াগরাজে ভিড় করিয়াছেন। কোটিপতির সহিত নগণ্য মানুষ, খ্যাতনামা, অখ্যাত-অজ্ঞাতকুলশীল সকলেই অবগাহন করিয়াছেন সঙ্গমে।
মহাকুম্ভে মারাত্মক জলদূষণের বিতর্কও দমাইতে পারে নাই পুণ্যলোভী জনতাকে। বরাবরের মতন বিজ্ঞান,যুক্তি ছাপাইয়া বড় হইয়া উঠে বিশ্বাস।কোটি কোটি মানুষ যেখানে ডুব দিয়াছেন, সঙ্গমের সেই জলরাশির গভীরতা হাঁটুজলের বেশি নয়।কোথাও কোথাও কোমরের নিচে। আজ হইতে ১৪৪ বছর পর আবারও গ্রহ-নক্ষত্রের মহামিলন মহাতিথির জন্ম হইলে মহাকুম্ভের যে আসর বসিবে, সঙ্গমস্থলে জলের ক্ষীণ প্রবাহও থাকিবে না।লাদাখের পরিবেশ আন্দোলনকর্মী শিক্ষাবিদ সোনম ওয়াংচুক দিল্লীতে সবাইকে সতর্ক করিয়া মঙ্গলবার বলিয়াছেন, লাদাখ সহ গোটা হিমালয়ে উষ্ণায়ন, সৈন্যদলের দাপাদাপি, অনিয়ন্ত্রিত পর্যটন পরিবেশের যে ক্ষতি করিয়া চলিয়াছে, তাহাতে ১৪৪ বছর পরের মহাকুম্ভের সঙ্গমে জলের পরিবর্তে বালিয়াড়ি থাকিবে।
পরিসংখ্যান দিয়া সোনম বলিতেছেন, উষ্ণায়ন যে হারে ঘটিতেছে, তাহাতে ২০৫০ সালে পৃথিবীর অধিকাংশ হিমবাহের দৈর্ঘ এক-তৃতীয়াংশ কমিয়া যাইবে।হিমালয়ের হিমবাহগুলি ক্রমে পিছাইয়া যাইতেছে।উদাহরণ লাদাখের নুব্রা উপত্যকায় খারদুংলা হিমবাহ।এই হিমবাহ পার হইবার জন্য সেনাবাহিনী লোহার সেতু তৈয়ার করিয়াছিল ১৯৯২ সালে।আজ সেই হিমবাহ ৫০০ মিটার পিছাইয়া গেছে,সেতুর প্রয়োজন পড়িতেছে না।সরকারকে সতর্ক করিয়া সোনম বলিয়াছেন, হিমালয় হইতে উৎপত্তি গঙ্গা, যমুনার মতন নদীগুলি হিমবাহ-নির্ভর। হিমবাহ না বাঁচিলে এই সব নদী বর্ষানির্ভর হইয়া পড়িবে। তেমন হইলে সঙ্গমে হাঁটুজলও থাকিবে না।
মহাকুম্ভ শুরুর আগেই উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ জানাইয়াছিলেন, দেশ-বিদেশের ৪০ কোটি পুণ্যার্থী সঙ্গমে ডুব দিতে আসিবেন। বুধবার শেষ দিনের স্নান শুরুর আগে সরকারী ঘোষণায় বলা হইয়াছে, প্রয়াগরাজে জনতার সংখ্যা ৬৫ কোটি ছাড়াইয়া গিয়াছে। এই বিশাল উদ্যাপন পুরোপুরি কুসুমকোমল না হইলেও যোগী আদিত্যনাথ অবশ্যই সাফল্যের দাবি করিতে পারেন। এত বছর ধরিয়া মহাকুম্ভের আয়োজন চলিলেও এই প্রথম উত্তরপ্রদেশ ও কেন্দ্রে বিজেপির সরকারের উপস্থিতিতে হইল। ফলে হিন্দুত্ববাদী বিজেপি কুম্ভের সফলতা কুড়াইতে প্রথম হইতেই সতর্ক ছিল। তাহা সত্ত্বেও অন্যান্যবারের মতন এইবারের মহাকুম্ভও দুর্ঘটনাবর্জিত হইল না। মেলায় পুণ্যার্থীদের তাঁবুতে একাধিকবার অগ্নিকাণ্ড। পদপিষ্ট হইয়া মৃত্যুর সংখ্যা লইয়া বিতর্ক শেষ হয় নাই। সঙ্গমমুখী যাত্রীবাহী ট্রেন ধরিতে দিল্লী স্টেশনে পদপিষ্ট হইয়াও মৃত্যু। আহত শতাধিক। সঙ্গমের পথে ঘটিয়াছে একাধিক সড়ক দুর্ঘটনা। তাহাতেও হতাহতের সংখ্যা নগণ্য নয়। ৬৫ কোটির সমাগমে এই সকল দুর্ঘটনার চাইতে আজ আমাদের সামনে অধিক গুরুত্ব থাকিবে গঙ্গার অমৃত স্রোতধারা অক্ষুণ্ণ রাখা। কীভাবে বাঁচাইয়া রাখা হিমালয়ের হিমবাহ।

Dainik Digital

Dainik Digital

Leave a Reply

Your email address will not be published.