স্বর্ণ মৃগয়া!!

বাল্মিকী রামায়ণের তৃতীয় খণ্ড অরণ্যকাণ্ড বলে, রাবণের নির্দেশে মারীচ নামে এক রাক্ষস সোনার হরিণ সেজে পঞ্চবটীর অরণ্যে সীতার অদূরে হাজির হয়।সূর্যের মতো মূর্ত,অপরূপ সুন্দর সেই হরিণ সীতাকে প্রলুব্ধ করে।সীতা স্বামীর কাছে সেই হরিণের আবদার করেন।
শ্রীরাম সেই হরিণের পশ্চাতে ধাবিত হয়ে দূরে সরে যান।বস্তুত,বাল্মিকী কৃত ওই ‘ম্যাজিক রিয়ালিজম’ থেকেই অশুভের উপর শুভশক্তির বিজয়-বৃত্তান্তের সূচনা হয়। বাকিটা অলিখিত বিস্তারেণ।
সোনার উপর নারীজাতির এমন মোহের সূচনা ঠিক কবে থেকে,সঠিক তথ্য নেই। গত বছর দেশের অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচনের প্রচারপর্বে মূলত হিন্দু মহিলাদের ভোটব্যাঙ্ককে নিশানা করতে গিয়ে নবেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, কংগ্রেস আর্থ সামাজিক সমীক্ষা চালিয়ে মা-বোনেদের সোনাদানা, এমনকী গলার মঙ্গলসূত্র ছিনিয়ে নিতে চাইছে। অনিবার্যভাবেই তা নিয়ে বিস্তর জল ঘোলা হয়েছিল। এখন আবার তরজায় কেন্দ্রে ফিরে এসেছে সোনা।
সম্প্রতি খোদ সরকারী তথ্য জানিয়েছে, মোদি জমানায় মহিলাদের সোনা বন্ধক রেখে ধার করার প্রবণতা অনেক বেড়েছে।নীতি আয়োগের সাম্প্রতিক রিপোর্টে বলা হয়েছে,মহিলারা ২০২৪-এ যতটা ধার করেছেন,তার ৩৮ শতাংশই সোনা বন্ধক রেখে নেওয়া। পাঁচ বছরে তা বেড়েছে ২২ শতাংশ।এর আগেই রিজার্ভ ব্যাঙ্ক জানিয়েছিল,গত অর্থবর্ষে সোনা বন্ধক রেখে ঋণের অঙ্ক ১.০২ লক্ষ কোটি টাকা ছুঁয়েছে, যা নজির। পাঁচ বছর আগেও (২০১৮-১৯) এই পরিমাণ ছিলো ২৫,০০০ কোটি। অতএব মোটামুটি স্পষ্ট যে, গৃহস্থ পরিবার আর্থিক সংকট ও ঋণের ভারে জর্জরিত। তাই ঘরের সোনা বার করতে হচ্ছে। এই সংকটের কারণ, রোজগারে ঘাটতি। ফলত, ক্রয়ক্ষমতায় ঘাটতি। ফলত, বাজারে চাহিদা নেই। ফলত, কমছে কারখানায় উৎপাদন। ফলত, ফেব্রুয়ারীতে দেশে উৎপাদনের সূচক ১৪ মাসের সর্বনিম্ন হয়েছে। এমনকি, উৎসবের মরশুমেও কারখানায় উৎপাদন যৎসামান্য বেড়েছে।
কংগ্রেস সভাপতিও এই মওকায় প্রধানমন্ত্রীকে আক্রমণ করেছেন।মন্তব্য করেছেন যে, আপনি মহিলাদের মঙ্গলসূত্র ছিনিয়ে নেওয়ার কথা বলেছিলেন, সেটাই সত্য হয়েছে। গৃহস্থের সঞ্চয় কমেছে তাই মহিলারা সংসার চালাতে গিয়ে আপনার জমানাতেই তাদের সবচেয়ে দামি বস্তু সোনা বন্ধক রেখে ঋণ নিতে বাধ্য হচ্ছেন। গৌরীদানের যুগের একশো বছর পরও ভারতের মানসপটে যে বিশেষ পরিবর্তন সূচিত হয়নি, সোনা অবশ্যই তার একটি সূচক। সমীক্ষা বলছে, একটি ভারতীয় পরিবার স্বর্ণালঙ্কারের পিছনে বিবাহ বাজেটের ২৫ শতাংশ ব্যয় করে। উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবারের সেই খরচ প্রায় ২৫ লাখ টাকা। প্রতি বিবাহে গড়ে ৩৯৪ গ্রাম সোনা (দুই পক্ষের পরিবার মিলিয়ে) কেনা হয়। মাথাপিছু সোনা কেনার হার উচ্চবিত্ত শ্রেণীতে বেশি হলেও, মোট সোনা সবচেয়ে বেশি কেনে মধ্যবিত্ত শ্রেণী (বার্ষিক আয় ২-১০ লাখ)।
সোনাকে স্ত্রীধন বলতেন মা-দিদিমারা। আজও হিন্দু দেওয়ানি আইনে সোনা স্ত্রীধন হিসাবেই চিহ্নিত। বর্তমান প্রজন্মের মেয়েরা যখন এতটাই আত্মনির্ভর, তবুও বিয়েতে সোনার গয়না এমন বাধ্যতামূলক কেন? সামান্য সম্মান কিনতে, নাকি শ্বশুরালয়ে পারিবারিক অত্যাচার থেকে বাঁচতে কন্যার অভিভাবকের কাছে এটাই একমাত্র পথ? নাকি স্ত্রীধন সংক্রান্ত দুর্বলতা? নাকি স্বর্ণ মৃগয়ার মধ্যে এক ধরনের ক্ষমতা প্রদর্শনের মানসিকতাও কাজ করে? বিবিধ রিপোর্ট জানাচ্ছে, ২০২৪-এ অর্থনীতির শ্লথ গতির ফলে পাঁচ বছরে ৩০০ শতাংশ বেড়েছে স্বর্ণঋণ। এই প্রথমবার সেটি ১ লক্ষ কোটি টাকার গণ্ডি অতিক্রম করেছে। আরবিআই সখেদে জানিয়েছে, বাড়ি-গাড়ি ঋণ বৃদ্ধির হার কমেছে, কিন্তু বিপদে পড়ে সোনা বন্ধক রেখে ধার বাড়ছে।ওই ঋণ ৭১.৩ শতাংশ বেড়েছে।ক্রমবর্ধমান স্বর্ণঋণের জন্য সরকারের অর্থনীতি কতখানি দায়ী, সে বিতর্ক অন্য।
উৎপাদনে মন্দার বিষয়টি স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও প্রকারান্তরে স্বীকার করে নিয়েছেন। দিন তিনেক আগে বাজেট এবং ছোট-মাঝারি শিল্প নিয়ে এক ভার্চুয়াল সম্মেলনে শিল্পমহলকে উৎপাদন ও রপ্তানিতে এগিয়ে আসার ডাক দিয়ে নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, শিল্পকে নীরব দর্শক হয়ে থাকলে চলবে না। ভারতে স্থিতিশীল নীতি ও ব্যবসার সহজ পরিবেশ আছে। বিশ্ব বাজারে জোগানের সুযোগও নিতে হবে। অর্থাৎ বিনিয়োগ নিয়ে চিন্তা রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর মাথাতেও। পরিশেষে প্রশ্ন, সোনার দামের ঊর্ধ্বগতি, সোনা বন্ধক দিয়ে ঋণের ক্রমবর্ধমান প্রবণতা ভারতীয় মহিলাদের বেঁচে থাকার স্বাধীনতাকে সাহায্য করছে, নাকি নীরবে হরণ করছে, নাকি অর্থনীতির দৈন্যদশা প্রকট করছে?