সামনা-র সংশয়!!

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশের জাতীয় রাজনীতির প্রেক্ষাপটে এমন অনেক পরিস্থিতি দেখা গেছে,যেখানে শত্রুরা বন্ধুতে পরিণত হয়েছে এবং বন্ধুরা সবচেয়ে বড় সমালোচক হয়ে প্রকাশ্যে এসেছে।যেমন মহারাষ্ট্রের ঘটনাই ধরা যাক।একটা সময় বিজেপি এবং শিবসেনা ছিল একে অপরের অভিন্ন হৃদয় তথা পরস্পরের দৃঢ় মিত্র।কিন্তু সময়ের হাত ধরে পরিস্থিতি এতটাই বদলে গেছে যে, বিজেপি এবং বাল ঠাকরের পুত্র উদ্ধবের শিবসেনা এখন একে অপরের তীব্র প্রতিদ্বন্দী।তারা শুধু আলাদাই হয়ে যায়নি, বরং শিবসেনা আজ দুইটি ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। একটির নেতৃত্বে একনাথ শিণ্ডে এবং অন্যটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন উদ্ধব।
তবে শিবসেনার একটা বিশেষত্ব হল, বিজেপির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় থাকার সময়েও বিভিন্ন ইস্যুতে সেনাকে বিজেপির কিছু কিছু কাজকর্ম নিয়ে প্রবল সমালোচনা করতে দেখা গেছে। মূলত শিবসেনার মুখপত্র ‘সামনা’ মহারাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত একটি মারাঠি ভাষার সংবাদপত্র।এই কাগজটি ১৯৮৮ সালে নেতাজীর জন্মজয়ন্তীর দিনে মহারাষ্ট্রের কট্টর ডানপন্থী রাজনৈতিক দল শিবসেনার প্রতিষ্ঠাতা বালা সাহেব ঠাকরের হাত ধরে প্রকাশিত হয়েছিল। শিবসেনার এই মুখপাত্র ‘সামনা’ এর আগে বিভিন্ন সময়ে পত্রিকার সম্পাদকীয় নিবন্ধে এমন কিছু বক্তব্য রেখেছে যা বিজেপির পক্ষে হজম করা ছিল কষ্টকর। তবে নানা ‘ইস্যুতে ‘সামনা’ তার নীতিগত অবস্থান স্পষ্ট করে গেলেও বিজেপির মূল ভিত্তি সম্পর্কে কখনোই আলটপকা মন্তব্য করেনি। কিন্তু বর্তমান বিজেপি দল ও সরকারের নেতৃত্বে নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদি ও অমিত শাহর অধিপত্য বিস্তার হতেই, উদ্ধব গোষ্ঠীর কঠোর সমালোচনার মুখে পড়তে হচ্ছে বিজেপি নেতৃত্বকে।এর আগেও পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু এবং মৌলানা আবুল কালাম আজাদকে বাদ দিয়ে ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাস সম্পূর্ণ হতে পারে না উল্লেখ করে শিবসেনার দলীয় মুখপত্রে মোদির ভূমিকা নিয়ে কাটাছেঁড়া করা হয়েছিল। সেই সঙ্গে আরএসএস এবং জনসংঘকেও তুলোধোনো করে পত্রিকাটি লিখেছিলো, ‘স্বাধীনতা আন্দোলনে জেল খেটেছেন নেহরু। অথচ ভারত ছাড়ো আন্দোলনে কোন ভূমিকাই ছিল না আরএসএসের। তাই নেহরুর কাছে মোদির কৃতজ্ঞ থাকা উচিত বলে উল্লেখ করেছিলো পত্রিকাটি। আসলে বিভিন্ন সময়েই বাল ঠাকরে প্রতিষ্ঠিত ‘সামনা’ যে বার্তাটি দেওয়ার চেষ্টা করেছে তা ছিল নেহরু বা প্রতিপক্ষ কোন দলের নীতির সঙ্গে মতবিরোধ থাকতেই পারে। কিন্তু ইতিহাস থেকে কোন কিছু মুছে ফেলার অর্থ স্বাধীনতাকে বিকৃত করা। দেশের স্বাধীনতার অমতকালে ৭৫ বছর পূর্তি নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদনে সামনা’ এই বক্তব্য পেশের পর, দলীয় মুখপত্রের সর্বশেষ সংস্করণ যা সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে তাকে ঘিরে জাতীয় রাজনীতিতে বড়সড় শোরগোল উঠেছে।সামনা পত্রিকার সর্বশেষ সংস্করণে লেখা হয়েছে ‘দেশ হিন্দু পাকিস্তানের দিকে এগোচ্ছে’।বলা হয়েছে, ধর্মের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা অনেক জাতি ভেঙে পড়েছে। পাকিস্তান তাদের মধ্যে একটি। পণ্ডিত নেহরুর মতো মানুষরা দেশটিকে ‘হিন্দু পাকিস্তান’ হতে দেননি বলেই দেশটি টিকে ছিল।কিন্তু মোদির আমলে দেশকে নতুন করে বিভাজিত করার দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। তারপরই লেখা হয়েছে, আমরা কি হিন্দু পাকিস্তানের দিকে এগোচ্ছি? দেশে সাম্প্রদায়িক ও ধর্মীয় ভেদাভেদ ভয়াবহভাবে বেড়েছে উল্লেখ করে বলা হয়েছে, দেশভাগের আগে ঠিক যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল গত ১০ বছরে ঠিক একই অবস্থা আবার দেখা দিচ্ছে। বর্তমানে কিছু হিন্দু নেতা জিন্নার ভূমিকা পালন করছেন। এটা দেশের জন্য বিপদজনক। হিন্দুদের মনে বিজেপি মুসলিম সম্পর্কে ঘৃণার বীজ বপন করছে অভিযোগ করে সামনা লিখেছে এরা ঔরঙ্গজেবের কবর উপড়ে ফেলতে চাইছে। এটা যারা চাইছে তারা ঔরঙ্গজেবের চেয়েও ভয়ানক। তারপরই সংঘের দিকে আঙুল তুলে প্রশ্ন ছোড়া হয়েছে মোহন ভাগবত কি এটা মানছেন? মোদি-শাহের বিরুদ্ধে উদ্ধবের ‘সামনা’ পত্রিকায় দেশ ভাঙার এই বিস্ফোরক অভিযোগকে শুধুই রাজনৈতির আঙ্গিকে না দেখে সংবেদনশীলতার নিরিখে তাকে বিশ্লেষণ করারও নিশ্চয় অবকাশ থাকবে। কারণ মোদি-শাহর রাজত্ব একদিন শেষ হবে, কিন্তু ততদিনে দেশ নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারবে কিনা এই সংশয়াত্মক বিষয়টি নিয়ে দেশের ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সংবিধানের মূল কাঠামোর অস্তিত্বের সামনে, গুরুতর প্রশ্নচিহ্ন তুলে ধরেছে।বিজেপির বিরুদ্ধে আরোপিত ‘হিন্দুত্ববাদের জিগির বনাম উদ্ধব ঠাকরের’ শিবসেনার এই বিস্ফোরক অভিযোগের মধ্যে আদৌ কতটা সারবত্তা রয়েছে তা হয়তো ভবিষ্যৎ বলবে। কিন্তু দেশ ভাঙার যে অভিযোগ সামনা জনসমক্ষে উত্থাপন করেছে তা অবশ্যই পর্যালোচনার দাবি রাখে।