এ কেমন পুনর্বাসন!!

 এ কেমন পুনর্বাসন!!
এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

এশিয়ার বৃহত্তম বস্তি মুম্বাইয়ের ধারাভি। ৬০০ একর এলাকা নিয়ে তার বিস্তার। সত্তর-আশি বছর ধরে ধারাভি ঘিরে অগণিত মানুষের স্বপ্ন, ভালো থাকা, ভালো রাখা, অসংখ্য নিম্নবিত্ত মানুষের সুখ-দুঃখের সংসার।সেই সংসারে হাত পড়তে চলেছে কর্পোরেত্মটর।দেশের অতিকায় এক বাণিজ্য গোষ্ঠীর সঙ্গে মহারাষ্ট্র সরকারের যৌথ অংশীদারিত্বে ধারাভির ছ’শো একরের মধ্যে প্রায় তিনশো একর জমিতে তৈরি হবে আধুনিক সভ্যতার সঙ্গে মানানসই ‘আর্বান-হাব’।তৈরি হবে আধুনিক বাজার, সুসজ্জিত আবাসন,বেসরকারী হাসপাতাল ইত্যাদি।যৌথ অংশীদারিত্বে ইতিমধ্যে তৈরি হয়েছে রাজ্য সরকারের উদ্যোগে নবভারত মেগা ডেভেলপার্স প্রাইভেট লিমিটেড, সংক্ষেপে এনএমডিপিএল নামে একটি এসপিভি বা বিধিবদ্ধ সংস্থা, এই প্রতিষ্ঠানই গোটা প্রকল্পটিকে রূপায়িত করবে।এই সংস্থার ৮০ শতাংশ মালিকানা কেন্দ্রীয় সরকারের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত সেই অতিকায় বাণিজ্য গোষ্ঠীর এবং বাকি ২০ শতাংশ রাজ্য আবাসন দপ্তরের অধীন বস্তি পুনর্বাসন পর্ষদের।
এ পর্যন্ত বোধগম্য।রহস্য ক্রমশ প্রকাশ্য। সর্বভারতীয় ইংরেজি দৈনিকের এক্সক্লুসিভ অন্তর্তদন্তমূলক প্রতিবেদনে সম্প্রতি প্রকাশ,গত অক্টোবরে মহারাষ্ট্র বিধানসভা নির্বাচনের দিন ঘোষণার ঠিক একদিন আগে ধারাভি বস্তির বাসিন্দাদের ভিটেহারা করে দেওয়ার ল্যান্ডফিল ডাম্পিং গ্রাউন্ডপুনর্বাসনের অতি স্পর্শকাতর সুবৃহৎ প্রকল্পটিতে ছাড়পত্র দেয় তদানীন্তন একনাথ সিন্ডে সরকার।শিন্ডে ছিলেন তখন মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী, উপমুখ্যমন্ত্রী ছিলেন বিজেপির দেবেন্দ্র ফড়নবীশ।বর্তমানে দেবেন্দ্র মুখ্যমন্ত্রী আর একনাথ উপমুখ্যমন্ত্রী। প্রকল্পের পোশাকি নাম ‘ধারাভি স্লাম রি-ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট’।এই প্রকল্পের আওতায় ধারাভি বস্তির ৫০ হাজার থেকে অন্তত ১ লক্ষ মানুষকে ভিটেহারা করে দেওনার ডাম্পিং গ্রাউন্ডে পুনর্বাসিত করা হবে।প্রশ্নটা এখানেই।এ কি পুনর্বাসন?নাকি নরকবাস?নাকি একেবারে স্বর্গবাস।
মোহনপুর মহকুমার দেবেন্দ্র নগর ডাম্পিং গ্রাউন্ডে যেমন আগরতলার সমস্ত কঠিন বর্জ্য প্রতিদিন জমা হয়, দেওনার ল্যান্ডফিলে তেমনই জমা হয় বাণিজ্য নগরীর সমস্ত কঠিন আবর্জনা। মুম্বাইয়ের সর্বপ্রাচীন, সর্ববৃহৎ কঠিন বর্জ্য ফেলার মাঠ এটি।১৯২৭ সাল থেকে মায়ানগরীর কঠিন জঞ্জাল দেওনারে জমা পড়ে চলেছে।কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্যদের রিপোর্ট বলছে, বর্তমানে সেখানে ২ কোটি টন কঠিন বর্জ্য রয়েছে।জঞ্জাল-পাহাড়ের উচ্চতা কোথাও ৭০ ফুট,কোথাও ১০০ ফুটেরও বেশি।সেই দেওনার ল্যান্ডফিলে ১২৪ একর জায়গা হাতে পেয়েছে এনএমডিপিএল।পরিবেশ রক্ষা কর্মী থেকে শুরু করে নাগরিক অধিকার রক্ষা কর্মীরা মহারাষ্ট্র সরকারের এমন কর্মকাণ্ড নিয়ে রীতিমতো উদ্বিগ্ন, চিন্তিত, হতবাক। কারণ, খোদ কেন্দ্রের দূষণ নিয়ন্ত্রণ বোর্ডের সর্বশেষ ২০২১ সালে প্রকাশিত রিপোর্টে দেওনার ল্যান্ডফিলকে ‘বিষাক্ত গ্যাসের এক অতিকায় মুক্তাঞ্চল হিসাবে চিহ্নিত। ২০২৪ সালে ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইবুনালকে দেওয়া পর্ষদের রিপোর্টে বলা হয়েছে, প্রতি ঘন্টায় দেওনার ডাম্পিং গ্রাউন্ডে ৬,২০২ কিলো মিথেন গ্যাস নির্গত হয়। এটা প্রতি ঘন্টায় হলে ২৪ ঘন্টায় কত? সাক্ষাৎ সেই নরকে ষাট-সত্তর হাজার গরিব নিম্নবিত্ত মানুষকে পুনর্বাসিত করা হবে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, বেশি মাত্রায় মিথেন গ্যাসের সংস্পর্শে এলে মানুষের মৃত্যু অবধারিত। অল্প মাত্রাতেও এই গ্যাস মানুষকে ধীরে ধীরে অন্ধ করে দিতে পারে, মানুষ স্মৃতিভ্রষ্ট হতে পারে, অকেজো হতে পারে ফুসফুস। কেন্দ্রের রিপোর্টেই বলছে, ভারতের শীর্ষ ২২টি মিথেন হটস্পটের মধ্যে দেওনার ল্যান্ডফিল অন্যতম। ২০২১ সালের সর্বশেষ পরিবেশ গাইডলাইনে নির্দেশিকা রয়েছে, কোনও জঞ্জাল ডাম্পিং গ্রাউন্ড, তা সে চালু থাক বা বন্ধ, তার ১০০ মিটার সীমানার মধ্যে স্কুল, হাসপাতাল, বসতি কিছুই নির্মাণ করা যাবে না।
তদুপরি দেওনার বন্ধ নয়, চালু ল্যান্ডফিল।কেন্দ্রীয় রিপোর্টেই উল্লেখ, সেখানে জঞ্জালের স্তূপ থেকে এমন সব তরল নিঃসৃত হয়, যা অত্যন্ত বিষাক্ত। টক্সিক গ্যাসের আধিক্যের কারণে ওই স্তূপে মাঝে-মধ্যেই সশব্দে বিস্ফোরণ হয়। মানুষের মৃত্যু পর্যন্ত হয়।এই প্রকল্পের রূপরেখা একটি সত্যকে উজাগর করেছে। সেটি হলো শাসকের কাছে শুধু পুঁজি, আর পুঁজিকে কেন্দ্র করে মুষ্টিমেয় কিছু লোকের ভালো থাকাটাই শেষ কথা, সাধারণ গরিব মানুষের প্রাণের মূল্য, জীবন সংগ্রামের মূল্য পোকামাকড়ের চেয়ে বেশি কিছু নয়। ইতিহাস সাক্ষী, হিটলারের নাৎসি জার্মানির ইহুদি গণহত্যাই হোক বা বর্তমানে ইজরায়েলের প্যালেস্তাইনে গণহত্যা, কিংবা সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপর অত্যাচার, এ সবই আসলে জাতিগত বিদ্বেষের প্রত্যক্ষ অভিঘাত। কিন্তু ধারাভিতে? এশিয়ার বৃহত্তম এই বস্তির প্রায় ৮০ শতাংশ বাসিন্দা হিন্দু’ তবে কি হিন্দুত্ব কথাটা কেবলই নির্বাচনে পারানির কড়ি, সঙ্ঘতন্ত্রেরপালে অক্সিজেন জোগানো,আরর বেকারত্বে জর্জরিত তরুণ সম্প্রদায়কে ভুলিয়ে রাখার ললিপপ।

Dainik Digital

Dainik Digital

Leave a Reply

Your email address will not be published.