যুদ্ধে ট্রাম্প কোথায়!!

 যুদ্ধে ট্রাম্প কোথায়!!
এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

যদিও সংঘর্ষ বিরতিতে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে আলোচনার শুরুবাত হইতেছে তথাপিও এই কথা আগাম বলা যাইবে ভারত ও পাকিস্তান আর একটি চিন্তাজনক বৃত্তে প্রবেশ করিল।ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে যখনই সংঘর্ষ বাধিয়াছে তখন বিশ্বসমাজ ইহাকে ধর্মভিত্তিক কিংবা কাশ্মীরকে কেন্দ্র করিয়া পুরাতন কাজিয়া বলিয়া ধরিয়া লয়। বহুদিন ধরিয়া চলিয়া আসা অমীমাংসিত দ্বন্দ্বযুদ্ধের আর একটি নূতন পর্ব বলিয়া দেখা হইয়া থাকে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি তাহার এক ভুল মন্তব্যেও এই কথাই বলিতে চাহিয়াছেন। ভুল ব্যাখ্যায় বলিয়াছেন, ‘কাশ্মীরে তাহারা হাজার বছর ধরিয়া যুদ্ধ করিয়া আসিতেছে, এবং সম্ভবত তাহার চাইতেও অধিক সময় ধরিয়া’। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পাকিস্তান এবং হিন্দুপ্রধান ভারত একাধিক যুদ্ধ ও বহু সংঘর্ষে জড়াইলেও দুই দেশের মধ্যকার সংঘর্ষ শেষ পর্যন্ত আলাপ-আলোচনা ও কূটনীতির টেবিলে মীমাংসা হইয়াছে। অনেক ক্ষেত্রে আমেরিকাকে মধ্যস্থতায় আগ্রহী হইতে বা মধ্যস্থতা করিতে দেখা গিয়াছে। যে ঘটনা এই দফায় অনেকটা অভাবনীয় কিংবা অনাকাঙিক্ষত বলিয়া ঠেকিতেছে।
ভারত-পাকিস্তান সংঘাতের পরিচিত সেই মহলকে আজিকার দিনে অতীত বলিয়াই মনে হয়।এপ্রিল মাসে কাশ্মীরে হিন্দু পর্যটকদিগের ওপর ধর্ম বিচার করিয়া সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জন নিহত হইয়াছে, ইহার পরেই দুই দেশের মধ্যে সাম্প্রতিকতম সামরিক উত্তেজনাকর পরিস্থিতির সূত্রপাত হয়। কিন্তু এই উত্তেজনা এতো দ্রুত সামরিক সংঘাতের রূপ পাওয়ার কারণ হইলো ভারত এবং পাকিস্তান বৈরিতা সাম্প্রতিক বছরগুলিতে বড় ও বিপজ্জনক দিকে মোড় লইয়াছে।আবার দুই পরমাণুধর প্রতিবেশীকে ধ্বংসাত্মক সংঘর্ষে জড়াইয়া পড়া হইতে নিবৃত্ত রাখিবার মতন কূটনৈতিক তৎপরতার পরিসরও সীমিত হইয়া গিয়াছে। বিশ্ব কূটনীতির পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ভারত ভূরাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তিকেন্দ্র হিসাবে আবির্ভূত। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভারতকে শুধু একটি মহান দেশ বলিয়াই নয়, এক সুমহান প্রাচীন সভ্যতার গৌরবময় উত্তরসূরি বলিয়াও প্রতিষ্ঠা করিতে চাহেন। তাহার এই দৃষ্টিভঙ্গি দিল্লীর নীতিনির্ধারকগণের মধ্যে এক আপসহীন মনোভাব
তৈরি করিয়াছে, এই কথা অনস্বীকার্য।সেই মনোভাবগত অবস্থান হইতে পাকিস্তানকে শুধু ব্যাঘাত সৃষ্টিকারী প্রতিবেশী হিসেবে নহে, বরং ভারতের ন্যায়সংগত জাগরণে বিশাল হুমকি সৃষ্টিকারী দেশ হিসাবে দেখিবার প্রবণতা পূর্বের চাইতে অনেকগুণ বাড়িয়াছে। ঘোষণা করা হইয়াছে, জম্মু কাশ্মীরের সীমানায় পাকিস্তানের মদতপ্রাপ্ত সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ এবং ভারতবিরোধী সন্ত্রাসবাদে পাকিস্তানের সমর্থন ভারত আর সহ্য করিবে না। সাদা চোখে দেখিলে পাকিস্তান ভারতের এই কঠোর অবস্থানে আরও বেশি করিয়া চিনের প্রভাব বলয়ে ঝুঁকিয়া গেল। ২৫ কোটি জনসংখ্যার দেশ পাকিস্তানের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ আরও কমিয়া গেল। বলাই বাহুল্য, পাকিস্তানের এই জনগোষ্ঠীর বিশাল অংশ এরই মধ্যে ভারত বিরোধিতার চাইতেও অধিক আমেরিকা বিরোধী মনোভাব পোষণ করে। ফলত এই অঞ্চলের সামনে যুদ্ধ যখন আঞ্চলিক সুস্থিতির সামনে চ্যালেঞ্জ হইয়া দাঁড়ায় তখন ভারতের সামনেও চ্যালেঞ্জগুলি গভীর হইবে।
অন্যদিকে পাকিস্তান গত দুই দশক ধরিয়া অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা সংকটে জর্জরিত। আজিকার দিনে পাকিস্তানে একটি প্রতিষ্ঠানই সর্বময় ক্ষমতাধারী। সে হইলো দেশটির সেনাবাহিনী। যদিও ভারতের সঙ্গে সংঘর্ষ শুরু হইবার আগে অবধি সেনা বাহিনীকেও সরকারটির মতনই ‘নালায়েক’ অভিধা শুনিতে হইয়াছে দেশবাসীর কাছ হইতে। পাকিস্তানে সেনাবাহিনী বরাবরের মতন আজও নীতিনির্ধারণে কর্তৃত্ব করে এবং তাহাদের হাতে রহিয়াছে উল্লেখ করিবার মতন প্রচলিত যুদ্ধ ও পারমাণবিক সামরিক শক্তি। বিপর্যয়ের পরেও, আঞ্চলিক শক্তি হিসাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করিবার উচ্চাকাঙ্ক্ষা পাকিস্তানের আজও বিদ্যমান। কাশ্মীর পাকিস্তানের জাতীয় পরিচয় ক্ষেত্রে একেবারে কেন্দ্রীয় এবং অগ্রাধিকার বিষয়। তাহারা কথায় কথায় বলিয়া থাকে, কাশ্মীর লইয়া ইসলামাবাদ দিল্লীর সঙ্গে আপস করিতে রাজি নহে।
গত কয়েক দশকে পাকিস্তানের প্ররোচনা, উসকানির মুখে ভারতকে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাপ্রতিম সংযম প্রদর্শন করিতে দেখা যায়। ২০০৮ সালে মুম্বাইয়ে পাকিস্তানি সন্ত্রাসী হামলায় ১৬৬ জনের মৃত্যুর পরেও ভারত শান্তিপূর্ণ সমাধানের আহ্বান জানাইয়া সংযত প্রতিক্রিয়া দেখাইয়াছিল। মোদির আমলের ভারত আগের অবস্থান বদলাইয়াছে। গত এক দশকে পাকিস্তানকে আন্তর্জাতিক পরিসরে একঘরে করিবার কৌশল লইয়াছে নয়াদিল্লী। আবার একই সময়ে পাকিস্তান এবং দেশটির সেনাবাহিনী তাহাদের ঐতিহ্যগত ভারত বিরোধী অবস্থানে খানিক অমনোযোগী, এমন ইঙ্গিত তাহারা দিয়াছিল।২০১৯ সালে পুলওয়ামা কাণ্ডের পর বালাকোট সীমান্ত সংঘর্ষের পর পাকিস্তান সংযত আচরণের দিকে ঝুঁকে, কিন্তু ভারত তাহার পথ বদল করিয়া লইতে থাকে। পহেলগাঁওয়ে সন্ত্রাসী হামলার পর হইতে ভারতের রাজনীতিবিদ ও বিশ্লেষকগণের চূড়ান্ত ধরনের কঠোর অবস্থান পাক ইস্যুতে ভারতের অবস্থান বদল স্পষ্ট করিয়াছে।তাঁহারা বলিয়াছেন,পাকিস্তান একটি ব্যর্থ ও উচ্ছৃঙ্খল রাষ্ট্র।ভারতকে অবশ্যই পাকিস্তান ধ্বংসের পথ কার্যকরভাবে খুঁজিয়া বাহির করিতে হইবে।
ভারতের কৌশলগত এই পরিবর্তন পাকিস্তান বুঝিতে পারিয়াছে ইহাতে সন্দেহ নাই। তাহারা দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতের প্রস্তুতি লইতে থাকে। ভারত ১৯৬০ সালের সিন্ধু জলচুক্তি স্থগিত করে। পাকিস্তান চুক্তি স্থগিত করিবার সিদ্ধান্তকে ‘যুদ্ধ ঘোষণার শামিল’ ঘোষণা দিয়া ১৯৭২ সালের সিমলা চুক্তি হইতে বাহিরে আসিবার হুমকি দেয়। অতীতে ভারত-পাকিস্তানকে কয়েকদফা যুদ্ধের প্রান্তসীমা হইতে ফিরাইয়া আনিতে মক্ষম হইয়াছিল ওয়াশিংটন।১৯৯৯ সালে তৎপরবর্তীতে ২০০১ সালে সক্ষম হইয়াছিল ওয়াশিংটন।১৯৯৯ সালে, তৎপরবর্তীতে ২০০১ সালে সংসদে সন্ত্রাসী হামলার পরও যুক্তরাষ্ট্রের ত্বরিত কূটনীতিতে উত্তেজনা প্রশমিত হইয়াছিল। ২০০৮ সালে মুম্বাই হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা উত্তেজনা প্রশমনে এই ঘটনার পশ্চাতে দায়ী কয়েকজনকে বিচারের আওতায় আনিতে সহায়তা করে। ওবামা প্রশাসনের সময়ে এবোটাবাদে ওসামা বিন লাদেনের ডেরার সন্ধান মিলিলে পাকিস্তান আমেরিকার নিকট অপাংক্তেয় হয়, আর বাইডেন প্রশাসন মূলত বেইজিংয়ের প্রভাব মোকাবিলায় নয়াদিল্লীকে আঞ্চলিক প্রতিপক্ষ হিসাবে পাশে পাইতে চাহিয়া ভারত-পাকিস্তান ইস্যু হইতে নিজেদের দূরে সরাইয়া রাখে।
ট্রাম্প প্রশাসন মোদির প্রতি দৃঢ় সমর্থন জানাইলেও মনোযোগ সীমাবদ্ধ রাখিয়াছিল শুল্ক বাণিজ্যযুদ্ধ, ইউক্রেন ও গাজায় সংঘাত এবং ইরানের কূটনীতিতে। তদুপরি নয়াদিল্লী এখন তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতাকে পাকিস্তানের পক্ষে পক্ষপাতদুষ্ট বলিয়া মনে করিয়া আসিতেছে আর ইসলামাবাদও পশ্চিমি দেশের সহিত ভারতের ঘনিষ্ঠতায় সন্দিহান। ফলে একসময়কার কার্যকর যোগাযোগগুলি যখন প্রায় ঠিক তখনই ভারতীয় সেনা পাকিস্তানের জঙ্গি ঘাঁটি চিহ্নিত করিয়া প্রত্যাঘাত চালায়। চিন পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব লইয়া প্রশ্ন তুলিলেও পাকিস্তানে জঙ্গি ঘাঁটিতে ভারতের প্রত্যাঘাত লইয়া নীরব ভূমিকা পালন করে। এই লইয়া পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর আক্ষেপ শোনা গিয়াছে। কিন্তু চতুর্থ দিনেই কোনও রকম ভূমিকা ব্যতিরেকে সংঘর্ষ বিরতির প্রস্তাব লইয়া আসিলেন ট্রাম্প। তৃতীয় দেশের উপস্থিতিতে আলোচনার কথাও বলিয়াছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতা ভারত স্বাগত জানাইবে কিনা দেশীয় রাজনীতিতে এই সময়ে ইহা বড় প্রশ্ন হইয়া সামনে ঝুলিতেছে। অতীতে পাকিস্তান বহুবার কাশ্মীর ইস্যুকে রাষ্ট্রপুঞ্জে তুলিতে চাহিয়াছে। আর ভারত কূটনৈতিকভাবে এই প্রসঙ্গ এড়াইয়া গেছে। কারণ ভারত বরাবর মনে করে তৃতীয় পক্ষের উপস্থিতি হইলো পাকিস্তানের প্রতি পক্ষপাত।
ওয়াশিংটন আজ বুঝিতেছে এশিয়ায় তাহার স্বার্থ এক ঝুঁকির মধ্যে পড়িয়াছে। এই মহাদেশে আমেরিকার ভবিষ্যতের জন্য ভারত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।বিশেষ করিয়া আমেরিকার সঙ্গে চিনের সাম্প্রতিক কালে সম্পর্কের যে অবনতি ইহা আর আগে কখনোই দেখা যায় নাই ভারতকে একপাক্ষিকভাবে ওয়াশিংটনের সমর্থন দেওয়া এবং পাকিস্তানের সহিত সম্পর্ক গুটাইয়া নেওয়ার অবস্থান কি নেবে ট্রাম্প? আবার এই অঞ্চলের নিরাপত্তায় বড় অবদান রক্ষাকারী এবং বাণিজ্যিক
অংশীদার হিসাবে ভারতের কার্যকারিতা তখন অনেকটাই দুর্বল হইয়া পড়িবে; যদি ভারত ব্যয়বহুল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অনন্তকাল ধরিয়া যুদ্ধে আটকাইয়া যায়।

Dainik Digital

Dainik Digital

Leave a Reply

Your email address will not be published.