ফ্যাটি লিভার ও ডায়াবেটিস : এক নীরব বিপদের যুগল সন্ধান!!

দৈনিক সংবাদ অনলাইন :-
আজকের দ্রুত পরিবর্তনশীল জীবনে ‘ফ্যাটি লিভার’ বা ‘হেপাটিক স্টিয়াটোসিস (Hepatic Steatosis) এক নীরব অথচ গভীর স্বাস্থ্যঝুঁকির প্রতীক হয়ে উঠেছে।
একইসঙ্গে ডায়াবেটিস মেলিটাস আমাদের ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এক মহামারীর রূপ নিয়েছে।কিন্তু, অনেকেই জানেন না এই দুটি রোগের মধ্যে একটি গভীর সম্পর্ক রয়েছে।
এই সম্পর্ক শুধু একটি সাধারণ সহাবস্থান নয়, বরং একে অপরকে তীব্রতর করে তোলা এক পরস্পরবর্ধক সংকট। এই প্রবন্ধে আমরা আলোচনা করবো- ফ্যাটি লিভার কী?
ডায়াবেটিসের সঙ্গে ফ্যাটি লিভারের সম্পর্ক কীভাবে তৈরি হয়?
কোলেস্টেরলের ভূমিকা কী?
ভবিষ্যতে এর জটিলতা কতখানি ভয়ঙ্কর হতে পারে?
প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের উপায়।
ফ্যাটি লিভার কী?
লিভার বা যকৃত আমাদের শরীরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলোর একটি, যা বিপাক (Metabolism), হরমোন নিয়ন্ত্রণ, ডিটক্সিফিকেশন এবং শক্তির মজুতসহ বহু গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে।
কিন্তু যদি লিভারে স্বাভাবিকের তুলনায় ৫-১০ শতাংশ বেশি চর্বি জমে, তখন তাকে ‘ফ্যাটি লিভার’ বলা হয়।
ফ্যাটি লিভার দুই ধরনের হতে পারে-
১. নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার ডিজিজ (NAFLD):অ্যালকোহল সেবন ছাড়াও যারা স্থূলতা, ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স, বা টাইপ ২ ডায়াবেটিসে ভুগছেন,তাদের ক্ষেত্রে দেখা যায়।
- ২. Alcoholic Fatty Liver Disease: অতিরিক্ত মদ্যপানের কারণে হয়।ভারতে এখন NAFLD-এর প্রকোপ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে, কারণ শহুরে জীবনযাত্রা, উচ্চ-ক্যালোরিযুক্ত খাদ্যাভ্যাস ও শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা ব্যাপক ডায়াবেটিস ও ফ্যাটি লিভার: অদৃশ্য যোগসূত্র টাইপ ২ ডায়াবেটিসের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হল ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স (Insulin Resistance)। এই ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স শুধু রক্তে গ্লুকোজ বাড়িয়ে তোলে না, বরং লিভারে চর্বি জমার পরিমাণও ক বাড়িয়ে তোলে। অর্থাৎ, ডায়াবেটিস থাকলে ফ্যাটি লিভারের ঝুঁকি স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি।
গবেষণা বলছে, প্রায় ৭০-৮০ শতাংশ টাইপ ২ ডায়াবেটিক রোগীর মধ্যে NAFLD দেখা যায়।আবার, ফ্যাটি লিভার থাকলে ইনসুলিন সঠিকভাবে কাজ করতে পারে না, ফলে রক্তে গ্লুকোজ আরও বেড়ে যায়।
এইভাবে একটি চক্রাকারে রোগ দুটি একে অপরকে তীব্রতর করে তোলে।এছাড়াও,NAFLD এক সময় Non-Alcoholic Steatohepatitis (NASH)-এ পরিণত হতে পারে, যেখানে লিভারে চর্বি জমার সঙ্গে সঙ্গে প্রদাহ (Inflammation) এবং কোষের ক্ষয় (Fibrosis) হতে শুরু করে। এটি পরবর্তীতে লিভার সিরোসিস (Cirrhosis) বা এমনকী লিভার ক্যানসার (Hepatocellular Carcinoma)-এও রূপ নিতে পারে।
রক্তে কোলেস্টেরল ও ট্রাইগ্লিসারাইড বৃদ্ধির প্রভাব ফ্যাটি লিভার সাধারণত Dyslipidemia নামক সমস্যার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত, যেখানে রক্তে ক্ষতিকর ফ্যাট উপাদান যেমন-Low-Density Lipoprotein (LDL – খারাপ কোলেস্টেরল) Very Low-Density Lipoprotein (VLDL) Triglycerides বেড়ে যায় এবং High-Density Lipoprotein (HDL – ভাল কোলেস্টেরল) কমে -যায়।
এই অবস্থা লিভারের কোষে অতিরিক্ত চর্বি জমাতে সাহায্য করে। উপরন্তু, ফ্যাটি লিভার থাকলে শরীরের লিপিড মেটাবলিজমের ভারসাম্য ভেঙে পড়ে। ফলস্বরূপ, রক্তে গ্লুকোজ এবং ফ্যাটের মাত্রা উভয়ই অস্বাভাবিক হয়ে যায়।
ফ্যাটি লিভার ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য কতটা বিপজ্জনক?
ফ্যাটি লিভার যাদের রয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত জটিলতাগুলির সম্ভাবনা ডায়াবেটিস থাকলে বহুগুণ বেড়ে যায়।
১. লিভার সিরোসিস ও লিভার ফেলিওর: লিভারের কোষ ক্ষয়ে গিয়ে স্থায়ীভাবে অকার্যকর হয়ে পড়ে।
২. লিভার ক্যানসার: বিশেষত Hepatocellular Carcinoma
৩. কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজ : হৃদরোগ, স্ট্রোক এবং হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়ে।
৪. কিডনি রোগ: ফ্যাটি লিভারের
কারণে কিডনির ক্ষতি ত্বরান্বিত হয়।৫. ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি ও রেটিনোপ্যাথি : ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স
ও রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে না থাকলে স্নায়ু ও চোখের ক্ষতি হয়।
ভবিষ্যতে বিপদ কতটা গুরুতর হতে পারে?
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) একাধিক রিপোর্টে দেখা গেছে, ফ্যাটি লিভারযুক্ত ডায়াবেটিক রোগীদের মধ্যে লিভার সিরোসিস বা লিভার ক্যানসারে মৃত্যুহার অনেক বেশি। NAFLD-এ আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে প্রায় ২০ শতাংশ লোক পরবর্তীতে NASH-এ এবং তার প্রায় ১৫-২০ শতাংশ লোক সিরোসিসে পরিণত হন।
ডায়াবেটিক রোগীদের লিভারে ফাইব্রোসিস দ্রুত গতিতে বৃদ্ধি পায়, এবং এটি একবার শুরু হলে, থামানো কঠিন হয়ে পড়ে।
চিকিৎসা ও নিয়ন্ত্রণ: কী করণীয়?
NAFLD এবং ডায়াবেটিস দুইই দীর্ঘমেয়াদি রোগ।
তবে লাইফস্টাইল পরিবর্তন, খাদ্যনিয়ন্ত্রণ, নিয়মিত ব্যায়াম ও ওষুধের মাধ্যমে এই রোগের অগ্রগতি অনেকাংশে রোধ করা যায়।১. ওজন নিয়ন্ত্রণ:-BMI ২৩-এর নিচে রাখতে হবে। পেটের চর্বি (Visceral Fat) কমানো সবচেয়ে জরুরি।২. খাদ্যাভ্যাস:-
লো ক্যালোরি ও লো কার্বোহাইড্রেট খাদ্য বেছে নিতে হবে।Trans fat saturated
fat-এ ভরপুর খাবার (ভাজাভুজি, ফাস্টফুড, রেড মিট) এড়াতে হবে।
Omega-3 fatty acids যুক্ত মাছ (যেমন রুই, কাতলা), বাদাম, অলিভ অয়েল গ্রহণ করা ভাল।
শর্করাযুক্ত পানীয় ও অতিরিক্ত ফলের রস এড়াতে হবে।৩. নিয়মিত ব্যায়াম:-
সপ্তাহে অন্তত ১৫০ মিনিট ব্রিস্ক হাঁটা বা সাইক্লিং প্রয়োজন। ইনসুলিন সেনসিটিভিটি বাড়ে, লিভারের চর্বিও কমে।৪. নিয়মিত স্বাস্থ্যপরীক্ষা:-
HbA1c, LFT (Liver Function Test) Lipid Profile, Ultrasound Abdomen ইত্যাদি পরীক্ষায় নজর দিতে হবে।৫. ওষুধকিছু ক্ষেত্রে Pioglitazone, Vitamin E, SGLT2 inhibitors বা GLP-1 analogues উপকারে আসে, তবে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া নয়।
উপসংহার:-ফ্যাটি লিভার এবং ডায়াবেটিসের এই বিপজ্জনক বন্ধুত্বকে অবহেলা করলে ভবিষ্যতে জীবনের মান নেমে যেতে পারে। তাই সময় থাকতেই জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আনুন। শুধু রক্তে গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণ করলেই হবে না, লিভারের স্বাস্থ্যও সমান গুরুত্বপূর্ণ।
স্বাস্থ্য একদিনে নষ্ট হয় না, কিন্তু একদিনেই শেষ হয়ে যেতে পারে-যদি আমরা অবহেলা করি।
আসুন, আজ থেকেই সচেতন হই এবং নিজের ও পরিবারের সুস্থ ভবিষ্যতের পথে এগিয়ে যাই।