সঙ্কট সর্বগ্রাসী
আলোচনা ছাড়াই কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সংসদে সকল বিল পাস করাইয়া অধিবেশনকে খালি মাঠে গোল দিবার ময়দান বানাইবার অঙ্ক হইতে সরিয়া আসিল মোদি সরকার । অত:পর বিরোধী দলের দাবি মানিয়া আলোচনা শুরু হইলো । বিতর্ক চলিতেছে । বিতর্কে উঠিয়া আসিতেছে নানান দিক । সোনিয়া গান্ধীকে ইডির হেনস্তা । প্রচণ্ড মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে গরিব মানুষের ওপর খাঁড়ার ঘা হিসাবে জিএসটির হার বৃদ্ধি ইত্যাদি লইয়া সকল বিরোধী দল সরকারকে একযোগে ধরিয়াছে । অর্থমন্ত্রী রাজি হইয়াছেন মূল্যবৃদ্ধি এবং আর্থিক অবস্থা ইত্যাদি লইয়া তিনি সংসদে বিবৃতি দিবেন ।
আজ এই কথা অস্বীকার করিবার উপায় নাই দেশের সাধারণ গরিব মানুষের আর্থিক অবস্থা শোচনীয় হইয়া উঠিয়াছে । বাজারে একদিকে যেমন পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি পাইয়াছে তেমনি পণ্যের চাহিদাও কমিয়া গিয়াছে । পণ্যমূল্যের বৃদ্ধি বিরোধীদের দাবি অস্বীকার করেন নাই অর্থমন্ত্রী। তবে তার দাবি নতুন করিয়া পণ্যমূল্য বৃদ্ধি হয় নাই । আবার দেশের আর্থিক অবস্থা যে ঠিক নাই তাহাও তিনি স্বীকার করিলেন তবে তাহাতে স্বীয় পাদটিকা রাখিয়াছেন । অর্থমন্ত্রী জানাইলেন , আর্থিক অবস্থার অবনতি ঘটিলেও বিশ্বের উন্নত এবং শীর্ষস্তরীয় উন্নয়নশীল দেশগুলির তুলনায় আমাদের দেশের অবস্থা তেমন খারাপ নহে ।
অর্থমন্ত্রীর এই পাদটিকা কতটুকু বাস্তব আর কতটা বিশ্বাস নির্ভর তাহা অবশ্য অদূর ভবিষ্যৎই বলিবে । তবে আলোচনা হওয়া গণতান্ত্রিক পরিকাঠামোতে সুস্থতার লক্ষণ , আপাতত ইহাই ভরসা । ইহার বাহিরে আর কিছুই নাই ভরসা করিবার মতন । অর্থমন্ত্রী যাহাই দাবি করুন না কেন এই সময়ে আস্ত মহাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা নুন আনিতে পান্তা ফুরায় অবস্থায় আসিয়া পৌঁছিয়াছে । আমাদের প্রতিবেশী দেশ সকলের অবস্থা ইউক্রেন যুদ্ধের পর আগের চাইতে অনেক খারাপ হইয়া পড়িয়াছে । এক কথায় উদ্ভূত পরিস্থিতিকে অর্থনৈতিক অস্থিরতা বলিতে হইবে ।
ভারতের চারিপাশের সকল দেশ যেমন পাকিস্তান , মায়ানমার , মালদ্বীপ , নেপাল , বাংলাদেশ এবং শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক অবস্থা যেন একই মুদ্রার এই পিঠ আর ওই পিঠ । স্বাধীনতার পর এই প্রথম অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়া ঘোষিত শ্রীলঙ্কা । চরম অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তায় পড়িয়া নেপাল সম্প্রতি তাহার কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের প্রধানকে হটাইয়া দিয়াছে । ইউক্রেন যুদ্ধের পর আপাত দৃষ্টিতে লাভজনক অবস্থানে রহিয়াছে হাতেগোনা যে এক দুইটি দেশ তাহার মধ্যে চিন অন্যতম । কিন্তু কোভিড বিধিনিষেধ চিনের অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলিয়াছে । ভারতের নিকটতম প্রতিবেশী পাকিস্তান এই সময়ে শ্রীলঙ্কার পদাঙ্ক অনুসরণ করিতেছে ।
তাহাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ফুরাইয়া আসিতেছে ইহার অর্থ হইলো ইসলামাবাদ ঝুঁকির সম্মুখীন । মালদ্বীপ , মায়ানমার , নেপালের অবস্থাও তথৈবচ । দ্রুত আইএমএফের ঋণের জন্য আমেরিকাকে আবেদন জানাইয়াছেন পাকিস্তানের নয়া প্রধানমন্ত্রী । আবার পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়া অনুরোধ পাঠাইয়াছেন আমেরিকার উপরাষ্ট্রপতি ওয়েন্ডি শেরম্যানের নিকট । ওই অনুরোধে পাকিস্তান বলিয়াছে তাহারা ঋণ খেলাপির বিরুদ্ধে লড়াই করিতেছে । তাই অবিলম্বে যেন ১৫০ কোটি ডলারের ঋণ মঞ্জুর করিয়া দেয় আইএমএফ ।
বিশ্বব্যাঙ্ক এই সময়ে শ্রীলঙ্কাকে আরও ত্রাণ দিবার আগে সেই দেশের নীতি কাঠামোর বিবরণ পাঠাইতে বলিয়াছে । আবার ভারতের আর এক নিকট প্রতিবেশী এই সময়ে বিশ্বব্যাঙ্কের নিকট ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ চাহিয়াছে । যদিও এই দেশে টাকার মূল্য ভারতীয় রুপির বিপরীতে কোথাও ধাক্কা খায় নাই । তুলনায় শ্রীলঙ্কা এবং পাকিস্তানে রুপি ক্র্যাশ করিয়াছে । ডলার ভারতে আগের তুলনায় দামি হইয়াছে । চিনা সহায়তা এবং ঋণ কমিয়া যাওয়ায় সব চাইতে বেশি ক্ষতির শিকার নেপাল এবং পাকিস্তান । আবার সামরিক শাসকের মায়ানমারের অবস্থা আর মালদ্বীপের অবস্থা প্রায় একই অবস্থায় রহিয়াছে ।
প্রতিবেশী দেশ সকলের সঙ্গে ভারতের কমবেশি ব্যবসাবাণিজ্য রহিয়াছে প্রথম হইতেই । দেশগুলির আর্থিক অবস্থা মন্দা হওয়ায় নি:সন্দেহে এই সকল দেশের সহিত ভারতের ব্যবসা কমিয়াছে বা আরও কমিয়া যাইবে । বৈদেশিক ব্যবসা মানে রপ্তানি কমিয়া যাওয়ার অর্থ হইলো দেশের রিজার্ভে বৈদেশিক মুদ্রার টান । কয়েক সপ্তাহ আগে এই আশঙ্কার কথাও জানাইয়াছেন অর্থনীতিকেরা । এই সকল সঙ্কটগুলির অন্যতম কারণ হিসাবে ধরা হইতেছে ইউক্রেন যুদ্ধ । পাঁচ মাস ধরিয়া যুদ্ধ চলিতেছে । ইহার সমাপ্তি কোন পথে তাহা জানা যাইতেছে না ।
আমেরিকা এবং ইউরোপ মস্কোর ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়াও কার্যত তাহা কার্যকর করিতে পারিতেছে -না । বরং ইউরোপ ফ্যাসাদে পড়িয়াছে রাশিয়া ইউরোপে জ্বালানি রপ্তানি কইয়া দেওয়ায় । জ্বালানি সঙ্কটের এই পর্বে আরও এক সমস্যার সম্মুখীন হইতে হইবে নয়াদিল্লীকে । আন্তর্জাতিক বাজারে রাসায়নিক সারের দাম বাড়িতেছে । ভারত রাসায়নিক সারের একটি বড় অংশ আমদানি করিয়া থাকে । ফলে বেশি দামেই কিনিতে হইবে । ফলে সংসদে বিরোধী সদস্যদের দাবি , প্রতিবাদ বহাল থাকিবে আর তার মধ্যেই আরও বাড়িবে পণ্যমূল্য ।