বঙ্গবন্ধু হত্যা ও আগস্ট ট্র‍াজেডি

 বঙ্গবন্ধু হত্যা ও আগস্ট ট্র‍াজেডি
এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পাঁচ দিনের মাথায় ঘাতকেরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে থাকেন । কথিত অভ্যুত্থানের পর পরই সৈয়দ ফারুকুর রহমান ও খোন্দকার আবদুর রশীদের নেতৃত্বে চার মেজর বঙ্গভবনে আশ্রয় নেন । তারা কোনওভাবেই সেনানিবাসে জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে থাকাটা নিরাপদ ভাবেননি । ফলে দুটি ক্ষমতাকেন্দ্র তৈরি হয় । একটি সেনানিবাসে , অন্যটি বঙ্গভবনে । ২০ আগষ্ট সকাল আটটা ৪৫ মিনিটে অন্যতম অভ্যুত্থানকারী মেজর মহিউদ্দিন সস্ত্রীক মার্কিন দূতাবাসের কনস্যুলার বিভাগে গিয়ে আশ্রয়ের অনুরোধ জানান । তার নেতৃত্বাধীন সেকেন্ড ফিল্ড আর্টিলারি রেজিমেন্টের অভ্যুত্থানে জড়িত সব মেজরকে নিরস্ত্র করা হয় । তিনি জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তাদের হাতে নিহত হতে পারেন বলে আশঙ্কা করছিলেন । ১৯ আগষ্ট মধ্যাহ্নে বঙ্গবন্ধুর সরকারী কার্যালয় গণভবনে দায়িত্বরত মহিউদ্দিন ও তার ইউনিটকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয় । ওইদিন বেলা দুইটায় তিনি বঙ্গভবনে যান চার অভ্যুত্থানকারী রশিদ , ফারুক , মহিউদ্দিন ( ল্যান্সার ) ও ডালিমের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাদের সতর্ক করে দিতে । তিনি ফারুকের সঙ্গে দেখা করে গণভবনে ফিরে আসেন এবং রাত সাড়ে আটটায় দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিয়ে সহযোগীদের সঙ্গে সেনানিবাসে ফিরে যান। নিজের বাসায় ফিরে আসার পর নয়টা পনেরো মিনিটে তার ব্যাজমেন্ট কর্নেল আনোয়ার হোসেন সেনাপ্রধানের নির্দেশে তাকে সেনানিবাস না ছাড়ার কথা বলেন । পরদিন সকালে তিনি কুর্তা ও পাজামা পরে সস্ত্রীক মার্কিন দূতাবাসে যান । তিনি আশঙ্কা করেন অভ্যুত্থানকারীর তালিকা তৈরি করা হয়েছে এবং তাদের সামরিক ট্রাইব্যুনাল নয় , সংক্ষিপ্ত আদালতে বিচার হবে বিদ্রোহ ও অবাধ্যতার অভিযোগে । সেদিনই মার্কিন দূতাবাস থেকে ওয়াশিংটনে জানানো হয় – মহিউদ্দিন আমাদের দূতাবাস প্রাঙ্গণে আসার পর প্রাথমিক কথাবার্তায় বুঝতে পারি তিনি জীবননাশের ঝুঁকিতে আছেন । মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় রাজনৈতিক আশ্রয় না দেওয়ার পরামর্শ দেয় , যদিও এটি তাদের নীতিবিরুদ্ধ । তাদের নীতি হলো আবেদনকারীর জীবনের শঙ্কা দেখা দিলে চরম ও ব্যতিক্রমী পরিস্থিতিতে সাময়িক আশ্রয় দেওয়া এবং যখন ঝুঁকি শেষ হয় কিংবা তার আগেই সেই আশ্রয়ের অনুমতি বাতিল করা । মহিউদ্দিনের ব্যাপারে দূতাবাসের নীতি ব্যাখ্যা করারও নির্দেশ দেওয়া হয় , যাতে তাকে দেখানো হয় যে মার্কিন সহায়তার ব্যাপারে খুবই কম সুযোগ রয়েছে এবং তাকে বাংলাদেশ ত্যাগ করানোর ব্যাপারে বা আমেরিকায় নিরাপত্তা দেওয়ার সুযোগ নেই। এই অবস্থায় মহিউদ্দিন স্বেচ্ছায় দূতাবাস ত্যাগ করেন। ৩ নভেম্বর খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে পাল্টা সেনা অভ্যুত্থান হওয়ার পরপরই ১৫ আগষ্টের অভ্যুত্থানকারী কর্নেল ফারুক রহমান , কর্নেল খোন্দকার আবদুর রশিদ ও শামসুল ইসলাম ডালিম ঢাকা ত্যাগ করেন । তাদের সঙ্গে আরও ছিলেন অন্যান্য ১২ কর্মকর্তা , দুজন নন কমিশন কর্মকর্তা , সাত নারী ও পাঁচ শিশু । চার নভেম্বর সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় ফারুক ব্যাংকক বিমানবন্দর থেকে মার্কিন দূতাবাসে টেলিফোন করে জানান , তিনি একজন বাংলাদেশি সেনা কর্মকর্তা , এখানে এসেছেন বিশেষ বিমানে । দূতাবাস কর্মকর্তা তাদের ভ্রমণসূচি জানতে চাইলে ফারুক বলেন , এক – দুই দিন পরই তারা বাংলাদেশে ফিরে যেতে চান । কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে এই অভ্যুত্থানকারীদের বাংলাদেশের বাইরেই আশ্রয় নিতে হয় । বিমানবন্দরে থাই পুলিশের মাধ্যমে থাই সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে তারা ব্যর্থ হন । এরপর পাকিস্তান দূতাবাসের সহায়তা চেয়েও তারা সফল হননি । দূতাবাস কর্মকর্তা জানান , তিনি তার কথাগুলো নোট নিয়েছেন এবং ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে জানাবেন । তিনি তাকে পুনরায় যোগাযোগ করা বা সহায়তার আশ্বাস দেননি । পরে বাংলাদেশ দূতাবাস থাই বহির্গমন ও শুল্ক বিভাগের ছাড়পত্র নেওয়ার ব্যবস্থা করে । তারা থাইল্যান্ডে পনেরো দিনের থাকার অনুমতি পান । ফারুক ব্যাংককের মার্কিন ও পাকিস্তান দূতাবাসে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন । পাঁচ নভেম্বর মার্কিন দূতাবাস ওয়াশিংটন জানায় , পাকিস্তান দূতাবাস বাংলাদেশি কর্মকর্তদের উৎসাহ ব্যাপারে দেখায় । দূতাবাসে ব্যাংককের রয়টার সংবাদদাতা রজার্স পাকিস্তান সেক্রেটারি খালেদ নিজামির উদ্ধৃতি দিয়ে জানান , পাকিস্তানে এই কর্মকর্তাদের আশ্রয় দেওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই । পাকিস্তানে ঢোকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ ছিল । আমেরিকাও মেজরদের আশ্রয় দেওয়ার বিরোধী । ছয় নভেম্বর ভারতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত স্যাক্সবি পররাষ্ট্র দপ্তরে পাঠানো বার্তায় জানান , আমি আনন্দিত যে বাংলাদেশ ত্যাগী মেজররা এখনও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয়ের আবেদন করেননি । আশা করি , তারা যাই করুন না কেন তা প্রত্যাখ্যাত হবেন । এই লোকগুলোর হাতে রক্ত আছে। ঢাকায় যারা নির্মমভাবে হত্যার শিকার হয়েছেন তারা সবসময় সুদক্ষ না হলেও নিবেদিত প্রাণ মানুষ , যেকোনও স্থান থেকে সহায়তা পেতে পারতেন , তারা এর চেয়ে ভালো হতে পারতেন । তিনি এ ব্যাপারে সজাগ ছিলেন যে মেজররা যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের অনুমতি পেলে ভারত তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখাবে । মুজিব নিহত হওয়ার পরপরই ভারত সরকারের কেউ কেউ মনে করেছেন , এই অভ্যুত্থানের সঙ্গে আমাদের যোগসাজশ আছে । এখন মেজরদের স্বাগত জানালে সেটাই সত্য বলে প্রতীয়মান হবে । এরপর আমাদের আরও বেশি যুক্তিসঙ্গত থাকতে হবে । আমি কোনও কারণ দেখি না যে এসব লোককে আমরা আশ্রয় দিয়ে নিজেদের কাঁধে বোঝা নেব , যাদের কৃতিত্ব হলো বাংলাদেশের নেতৃত্বের একটি ভালো অংশকে নির্মূল করে দেওয়া । ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত বোস্টারও ঘাতকদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের অনুমতি দেওয়ার বিরোধিতা করে লিখেছেন , আমরা রাষ্ট্রদূত স্যাক্সাবির সুপারিশকে জোরালোভাবে সমর্থন করি যে ব্যাংককে অবস্থিত মেজরদের এখন অস্থায়ী বা স্থায়ীভাবে আশ্রয়ে অনুমতি না দেওয়া । তখনও ফারুক আশা করছেন , জিয়ার পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হলে তাদের দেশে ফেরার অনুকূল পরিবেশ আসবে । পররাষ্ট্র দপ্তরের নির্দেশে মার্কিন দূতাবাস ফারুক ও অন্যদের সঙ্গে ন্যূনতম যোগাযোগ রক্ষা করে চলে । ফারুকের আবেদনের ব্যাপারে তারা ওয়াশিংটনের পরবর্তী নির্দেশের অপেক্ষা করে । ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন জার্মান রাষ্ট্রদূত উইলি আলবার্ড বিট্টার বোস্টারকে জানান , মেজররা তার দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেছিলেন । কিন্তু বনে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস পরামর্শ দেয় যে এ ধরনের কোনও আবেদন যেন তারা নাকচ করে দেন । কেননা তারা খুনি । বিট্টার তাদের আশ্রয়ের আবেদন মঞ্জুর না করার পরামর্শ দেন এই যুক্তিতে যে তাতে জার্মানিতে রাজনৈতিক সমস্যা সৃষ্টি হবে । তেরো নভেম্বর একজন আমেরিকান ব্যবসায়ী মেজরদের কাছ থেকে একটি বার্তা নিয়ে ব্যাংকক থেকে ঢাকায় আসেন । সেটি হলো , তারা দেশে ফিরে আসতে চান । ব্যাংককে যাওয়ার পর মেজরেরা মোশতাক ও জিয়ার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন । বারো নভেম্বর তারা দুজনই মেজরদের টেলিফোন করেন । আমেরিকার প্রবাসী ব্যবসায়ী মেজরদের যে চিঠি নিয়ে এসেছিলেন তা জিয়া , মোশতাক ও অন্যদের হাতে দেন । তিনি মার্কিন দূতাবাসকে জানান , ফারুক ও রশিদ ছাড়া অন্যদের দেশে আসার অনুমতি দেওয়া হবে । এদিকে বাংলাদেশ সরকার মেজরদের হংকংয়ে আশ্রয়ের অনুরোধ জানালে ব্রিটিশ সরকার তা নাকচ করে দেয় । তৎকালীন ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত স্মলম্যান পররাষ্ট্রসচিব ফখরুদ্দিন আহমদকে জানান , ব্রিটেন এই সমস্যার বাইরে থাকতে চায়। ১৭ নভেম্বর বোস্টার ও তার সহকর্মী চেসল বিচারপতি সায়েমের সঙ্গে দেখা করতে এলেও নতুন পররাষ্ট্রসচিব তবারক হোসেন ও মোশতাকের মুখ্যসচিব এম . চাষী তাদের সঙ্গে মেজরদের আশ্রয়ের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন । তারা বলেন , একদিন আগেও ভাবেননি যে ব্যাংককে তাদের থাকতে সমস্যা হবে । থাই সরকার তাদের ভিসা বাড়াতে অস্বীকৃতি জানায় । এ অবস্থায় বাংলাদেশের কর্মকর্তারা আশা করেন , অন্য দেশ না হলেও অন্তত যুক্তরাষ্ট্র স্থায়ী ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত অস্থায়ী আবাসনের অনুমতি দেবে । বোস্টার জানতে চান কেন মেজরেরা ঢাকায় ফিরে আসছেন না ? চাষী জবাব দেন , তাতে সেনাবাহিনীর মধ্যে সমস্যা হবে । তারা ফিরে এলে স্বাভাবিক অবস্থাও ব্যাহত হবে । একই সঙ্গে ব্রিটেনের সঙ্গেও বাংলাদেশ সরকার অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগ রাখে । কিন্তু তারা সহায়তা করতে রাজি নয় , খবর প্রচারিত হওয়ার পর মনোভাব পরিবর্তন করে । বোস্টার বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধটি ওয়াশিংটনে পাঠানো হবে এই মর্মে প্রতিশ্রুতি দেন এবং বলেন , দুজনেরই অন্য কোনও দেশ বেছে নেওয়া উচিত । আমেরিকায় আশ্রয় পাওয়ার সম্ভাবনা কম । এরপর চাষী ল্যাটিন আমেরিকার কোনও দেশে মেজরদের আশ্রয় দেওয়ার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রকে ভূমিকা রাখতে বললে বোস্টার বলেন , সেখানে তো বাংলাদেশেরই নিজস্ব মিশন আছে । তিনি আরও জানান , সামরিক চক্রকে অস্থায়ী বা রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়ার জন্য আমি সুপারিশ করব না । ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হতে পারে । তবে পররাষ্ট্র দপ্তর থাই সরকারকে আরও কিছুটা সময় দেওয়ার অনুরোধ জানাতে পারে। ২০ নভেম্বর ফারুক ব্যাংককে মার্কিন দূতাবাসের রাজনৈতিক কাউন্সিলরকে জানান , পরদিনই তারা লিবয়ায় চলে যাচ্ছেন । যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় পাওয়ার জন্য আবেদন জানাতে আগ্রহী নন । মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর ইতিমধ্যে ব্যাংকক মিশনকে ফারুককে এই কথা বলতে বলেছে যে যুক্তরাষ্ট্র রাজনৈতিক আশ্রয় দেবে না । কিন্তু ফারুকের সঙ্গে দূতাবাসের যোগাযোগের আগেই তিনি লিবিয়ার ভিসা পেয়ে যান । ফারুক ব্যাংকক থেকে নিয়মিত টেলিফোনে খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন । তার ধারণা ছিল, মোশতাক এখনও বাংলাদেশে অন্য যে কারও চেয়ে প্রভাবশালী । বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ই তাদের পাসপোর্ট ঢাকায় এনে লিবিয় ভিসা জোগাড় করে দেয় । ফারুক মার্কিন কর্মকর্তাকে জানান , তিনি দেশের বাইরে থাকতে চান , যাতে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটে । বাংলাদেশে ভারতের উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি ছিলেন ঘোরতর সন্দেহবাদী । ফারুক ইন্দোনেশিয়া থেকে আটলান্টিক পর্যন্ত মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে তার কমিউনিস্টবিরোধী বলয় প্রতিষ্ঠার মহাপরিকল্পনার কথা বলেন । তার ধারণা , কোনও মুসলিম দেশই কমিউনিস্ট ব্যবস্থা মেনে নিতে পারে না । ফারুক – রশিদ ভেবেছিলেন যারা সাত নভেম্বরের বিদ্রোহ ঘটাচ্ছেন তারা তাদের দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার দাবি জানাবেন । কিন্তু বাস্তবে সেটা ঘটেনি । বাংলাদেশের মানুষ যা – ই ভাবুন না কেন , অনেক খ্যাতনামা বিদেশি নাগরিক অন্তত তাদের ভয়ঙ্কর নৃশংসতাকে মেনে নিতে পারেননি । তিনি অভ্যুত্থানকারীদের চিহ্নিত করেছেন আগাপাছতলা অপরাধী । তার নাম ভিক্টর এইচ উমদিবট আন্তর্জাতিক রেডক্রসের পরিচালক ও জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ প্রতিনিধি । তিনি ব্যাংককে মার্কিন দূতাবাসকে বাংলাদেশে নভেম্বরের শুরুতে যা দেখে এসেছেন তার বিবরণ দিয়েছেন । তিনি তাদের অভ্যুত্থানকারীদের আশ্রয় না দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন , ৩ নভেম্বর ঢাকায় বেশ কিছু ব্যস্ত দিন কাটানোর পর আমি বাংলাদেশ থেকে ফিরে এসেছি । এটি ছিল সেই সময় যখন দ্বিতীয় পর্যায়ের হত্যাকাণ্ড ঘটেছে এবং প্রেসিডেন্ট খোন্দকার মোশতাক আহমদকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে । ছয় নভেম্বর হত্যাকাণ্ডের আগে আমি মোশতাক ও তার মন্ত্রিসভার কয়েকজন সদস্যের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা করি । বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যাপক উদ্বেগ , যা আমি প্রত্যক্ষ এবং আঁচ করেছি আপনাকে এবং আপনার মাধ্যমে অন্যান্য আমেরিকান কর্তৃপক্ষকে জানাচ্ছি । শেখের হত্যাকারী ও তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল মানুষগুলো আপনার কাছে রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য ধরনা দিয়েছেন – আমি প্রার্থনা করি , আমেরিকান কর্তৃপক্ষ যথার্থভাবেই তা নাকচ করে দেবে । বাংলাদেশের মন্ত্রিসভার সদস্যদের কাছ থেকে আমি যেসব তথ্য পেয়েছি , তাতে এই উর্দিধারী ব্যক্তিরা আগাপাছতলা অপরাধী । তিনি আরও লিখেছেন , তারা কেবল শেখ মুজিবুর রহমানকেই হত্যা করেনি , হত্যা করেছে তাঁর স্ত্রী , দুই বিবাহিত ছেলে , তাঁদের স্ত্রীদ্বয় । একজনের বিয়ে হয়েছে পনেরো মাস আগে , আরেকজনের তিন সপ্তাহ আগে । তারা শেখের ১১ বছর বয়সি কনিষ্ঠ সন্তানকে বাগানে নিয়ে গিয়ে হত্যা করেছে । এই বর্বরতা ও নিষ্ঠুরতা বর্ণনা করার ভাষা আমার জানা নেই । এই অপরাধীদের উচিত বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো এবং সামরিক আদালতে বিচার করা । আর আমেরিকা উদারতা ও মহত্বের ঐতিহ্য সত্ত্বেও এই ডাকাতদের জন্য দরজা খুলে রাখতে পারে না । এই শোক ও বেদনাহত অভিমত প্রকাশের জন্য আমি ক্ষমা প্রার্থনা করছি । কিন্তু অন্যদের থেকে বাংলাদেশের ঘটনাবলী সম্ভবত ভালো জানার কারণে আমি মনে করি আমেরিকান কর্তৃপক্ষকে সত্য জানানো আমার দায়িত্ব । প্রথমে আমি ভেবেছিলাম ওয়াশিংটনে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আমার এক বন্ধুকে চিঠি লিখব , কিন্তু আমি তাদের প্রশাসনিক কার্যক্রম সম্পর্কে কিছুই জানি না , এসব দেখার দায়িত্ব অন্য কোনও কি না । এ কারণেই আমি এই চিঠি আপনাকে লিখছি । ‘ ১৫ আগষ্টের বেদনাদায়ক ঘটনার পর একজন বিদেশি নাগরিক ঘাতকদের চরিত্র চিনতে পারলেও আমাদের অনেক লেখক – বুদ্ধিজীবীদের জানতে অনেক সময় লেগেছিল। এটাই ইতিহাসের ট্র‍্যাজেডি।

লিখেছেন- সোহরাব হাসান

Dainik Digital

Dainik Digital

Leave a Reply

Your email address will not be published.