শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আইডিইউ, এইডসঃ পশ্চিম জেলায় চিহ্নিত ৫৭ স্কুল-কলেজ

 শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আইডিইউ, এইডসঃ পশ্চিম জেলায় চিহ্নিত ৫৭ স্কুল-কলেজ
এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

রাজধানী আগরতলা সহ গোটা পশ্চিম জেলার স্কুল , কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বিপজ্জনক শিরা পথে ড্রাগ গ্রহণ এবং এইডস সংক্রমণ অতি উদ্বেগজনকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে । সেই সাথে বাড়ছে রক্তবাহিত আরও দুটি মারণ ভাইরাস হেপাটাইটিস বি এবং হেপাটাইটিস সি সংক্রমণ । শহর ও শহরতলির বহু বনেদি স্কুল কলেজে ঢুকে পড়েছে এই মৃত্যুফাঁদ ।। শুধু স্কুল কলেজের ছাত্রছাত্রী নয় , সমাজের প্রতিটি পেশাজীবী এমনকি বেকার যুবকযুবতীরাও এই নেশার জালে জড়িয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে । পরিস্থিতির অতি দ্রুত অবনতি হচ্ছে । অনতিবিলম্বে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ মহল । ত্রিপুরা রাজ্য এইডস কন্ট্রোল সোসাইটির সর্বশেষ একটি রিপোর্ট নিঃসন্দেহে রাজ্যের সচেতন অভিভাবকদের রাতের ঘুম কেড়ে নেবে । সোসাইটি পশ্চিম ত্রিপুরা জেলার ৫৭ টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সমীক্ষা চালিয়ে ১৯৩ জন ছাত্রছাত্রীকে চিহ্নিত করতে পেরেছে , যারা নিয়মিত শিরাপথে ড্রাগ নিয়ে নেশা করে । এদের মধ্যে ৬২ জন এইচআইভি পজিটিভ । এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে ৪৭ টি স্কুল ও ১০ টি কলেজ , বিশ্ববিদ্যালয় । ৪৭ টি স্কুলে আইডিইউ চিহ্নিত হয়েছে ১৩৮ জন ছাত্রছাত্রী । এদের মধ্যে ৫২ ইতোমধ্যেই এইচআইভি সংক্রমণের শিকার । আর ১০ টি উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আইডিইউ চিহ্নিত হয়েছে ৫৫ জন । এদের মধ্যে জন এইচআইভি পজিটিভ ১০ জন । শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করা হলো না । প্রতিষ্ঠানের ঐতিহ্য ও সুনাম এবং ছাত্রছাত্রীদের ভবিষ্যতের কথা বিবেচনা করে । শহর ও শহরতলির অনেক বনেদি স্কুল কলেজ এই তালিকায় রয়েছে । সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের ধারণা , প্রকৃত সংখ্যা অনেক অনেক বেশি হবে । বিভিন্ন কৌশলে এদের চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে । বাকিরা লুকিয়ে নেশা করছে । একাংশ নেশাসক্ত ছাত্রছাত্রীর অভিভাবকগণ এখনও অজ্ঞাত । আইডিইউ নেশাসক্ত ছাড়াও রয়েছে অন্য নেশাগ্রস্ত । এরা ট্যাবলেট , তরল এবং ধোঁয়াজাতীয় বিভিন্ন ধরনের জিনিস গ্রহণ করে নেশা করে । এইসব নেশা অনেক দিন করার পর আরও কড়া নেশার জন্য শিরাপথে ড্রাগ নিতে শুরু করে । এরা একই সিরিঞ্জ দিয়ে গ্রুপের সকলে শিরায় ড্রাগ নিয়ে থাকে । এই কারণে সহজেই এরা রক্তবাহিত বিভিন্ন মারণ ভাইরাসের সংক্রমণের শিকার হয়ে যায় । যেমন এইচআইভি , হেপাটাইটিস বি এবং হেপাটাইটিস সি । ত্রিপুরা এইডস কন্ট্রোল সোসাইটির রিপোর্ট থেকে জানা যায় , জেলায় এইচআইভি সংক্রমণের গ্রাফ অতি দ্রুত বাড়ছে । ২০১৮-১৯ বর্ষে জেলায় ১৪৮০৪৬ জনকে পরীক্ষা করে ৩৩৮ জন এইচআইভি পজিটিভ পাওয়া গিয়েছে । শতকরা ০.২৩ শতাংশ । ২০২১-২২ বর্ষে পরীক্ষা করা হয় ১৭৫৯৬১ জনকে । এদের মধ্যে এইচআইভি পজিটিভ চিহ্নিত হয়েছে ১১২৪ জন । শতকরা ০.৬৪ শতাংশ । এ বছরের এপ্রিল থেকে জুলাই পর্যন্ত চার মাসে পরীক্ষা করা হয়েছে ৫৭২৮৬ জনকে । পজিটিভ ৭১১ জন । শতকরা ১.২ শতাংশ । এই তথ্য থেকে অনুমান করা যায় সংক্রমণ কত দ্রুত বাড়ছে । সদর মহকুমায় চিহ্নিত মহিলা যৌনকর্মী ২০১৮-১৯ বর্ষে ছিলো ১৩০ জন ( ২ জন পজিটিভ ) । ২০২১-২২ বর্ষে এই এইচআইভি সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬৪ জন । সদরে ২০২০-২১ বর্ষে চিহ্নিত আইডিইউ সংখ্যা ছিল ২২১ জন । এদের মধ্যে ২৩ জন এইচআইভি পজিটিভ । ২০২১-২২ বর্ষে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৬২ জন । এদের মধ্যে ৬৩ জন এইচআইভি পজিটিভ । মোহনপুর মহকুমায় আইডিইউ চিহ্নিত হয়েছে । ২০২১-২২ বর্ষে ৩২৪ জন । এদের মধ্যে ৪৫ জন এইচআইভি পজিটিভ । জিরানীয়া মহকুমায় আইডিইউ চিহ্নিত হয়েছে ২৫৬ জন । এদের মধ্যে ১৮ জন এইচআইভি পজিটিভ । যাদের শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি , সেই সংখ্যাটা অনেক বেশি হবে । গত জুলাই মাসের তথ্য অনুযায়ী এআরটি সেন্টারে নথিভুক্ত এইচআইভি পজিটিভ রোগীর সংখ্যা সদরে ৪৩৪ জন , মোহনপুরে ২৫১ জন এবং জিরানীয়ায় ২৩২ জন । সামাজিক অসহযোগিতা ও লোকলজ্জার ভয়ে সরকারী চিকিৎসা ব্যবস্থার সাথে যুক্ত হয়নি কিংবা নিজেকে লুকিয়ে রেখেছে এমন রোগীর সংখ্যা কয়েক হাজার হবে । এইডস কন্ট্রোল সোসাইটি সূত্রে জানা গিয়েছে , অন্য জেলাগুলিতেও এইডস আইডিইউ সহ নেশার সমস্যা দ্রুত বাড়ছে । নেশায় আসক্ত ছেলেমেয়েদের নিয়ে অভিভাবকগণ দিশেহারা হয়ে পড়েছেন । কোনওভাবেই তাদের এই নেশার জাল থেকে বের করে আনতে পারছেন না । দিন দিন তাদের শারীরিক অবস্থার অবনতি হচ্ছে । এদের চিকিৎসার সুব্যবস্থা এখনও রাজ্যে সীমিত । একটি মাত্র সরকারী পুনর্বাসন কেন্দ্র রয়েছে নরসিংগড়স্থিত মানসিক হাসপাতালে । এর বাইরে জেলায় আরও ৩১ টি বেসরকারী রি – হ্যাব সেন্টার রয়েছে । এই সেন্টারগুলির সরকারী অনুমোদন নেই । স্বাভাবিকভাবেই সরকারী পর্যবেক্ষণও নেই । মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে অভিভাবকগণ ছেলেমেয়েদের এই সকল রি – হ্যাব সেন্টারে ভর্তি করাচ্ছেন । কিন্তু সন্তোষজনক পরিষেবা কোথাও নেই । অজস্র অভিযোগ রয়েছে অভিভাবকদের । সরকার এই রি – হ্যাব সেন্টারগুলি সম্পর্কে রহস্যজনকভাবে উদাসীন । ইতোপূর্বে সরকারী তরফে একাধিকবার ঘোষণা করা হয়েছে , উত্তর জেলায় একটি বৃহৎ পরিসরে পুনর্বাসন কেন্দ্র গড়ে তোলা হবে । কিন্তু সেই ঘোষণা এখনও বাস্তবের মাটিতে নেমে আসেনি । ত্রিপুরা এইডস কন্ট্রোল সোসাইটি রাজ্যে এইচআইভি / এইডস এবং শিরাপথে ড্রাগ গ্রহণকারীদের নিয়ে কাজ করছে । সোসাইটির নথিভুক্ত এনজিও – র মাধ্যমে এদের শনাক্ত করে কাউন্সিলিং এবং উপযুক্ত চিকিৎসা সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে । কিন্তু এ কাজে বড় সমস্যা হলো এদের খুঁজে বের করে চিকিৎসা ব্যবস্থার নিরে আসা এবং ধরে রাখা । সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের অভিমত , এইডস এবং নেশার সমস্যা যে গতিতে বেড়ে চলেছে , তা একটি সরকারী সোসাইটি ( যার পরিকাঠামো সীমিত ) এবং সোসাইটি নিয়ন্ত্রিত কয়েকটি এনজিও দিয়ে নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয় । রাজ্যকে নেশা ও এইডস মুক্ত করতে হলে প্রয়োজন সরকারের সর্বোচ্চ স্তরে উদ্যোগ গ্রহণ । পুলিশ , স্বাস্থ্য , শিক্ষা , সমাজকল্যাণ সহ সংশ্লিষ্ট সকল দপ্তর , জনপ্রতিনিধি , এনজিও সকলের মতামতের ভিত্তিতে অ্যাকশন প্ল্যান তৈরি করে মাঠে নামতে হবে । এক্ষুনি নিয়ন্ত্রণে না আনতে পারলে রাজ্যের নতুন প্রজন্মের বড় ক্ষতি হয়ে যাবে ।

Dainik Digital

Dainik Digital

Leave a Reply

Your email address will not be published.