রাশিয়ার আগ্রাসী পুতিন
ফেব্রুয়ারী মাসের শেষ সপ্তাহে শুরু হইয়াছিল রাশিয়া ইউক্রেনের যুদ্ধ । দেখিতে দেখিতে ছয়মাস অতিক্রান্ত । যুদ্ধ শেষ হইবার নাম নাই । যুদ্ধ চলিতেছে , দীর্ঘায়িত হইতেছে দুর্ভোগের কাল । কোনও পক্ষই নমনীয় নহে । আর যত দিন যাইতেছে নিজেদের হম্বিতম্বি কমাইয়া যুদ্ধক্ষেত্র হইতে দূরত্ব বাড়াইয়া চলিতেছে ইউরোপ এবং আমেরিকা । সে না হয় বুঝা গেল , কেহই একটি বৃহত্তর যুদ্ধ বা বিশ্বযুদ্ধের দিকে যাইতে আগ্রহী নহে । কিন্তু কেমন আছে রাশিয়া ? কেমন আছেন পুতিন ? এই লইয়া কৌতূহল আসিতেই পারে । ইউক্রেনের সমূহ ক্ষতির পর সেই দেশের মানুষের অশেষ ক্ষতি সাধিত হইয়াছে । দেশের অর্থনীতি যেমন পর্যুদস্ত হইবার কথা তাহা হইয়াছে । এরপরও রাশিয়ার পক্ষে ইউক্রেন অধিকার করিয়া লওয়া বা উহার পতন ঘটানো সম্ভব হইতেছে না ।
এক শক্ত প্রতিরোধের সম্মুখে রাশিয়ার সেনা বাহিনী ধীরে চলিবার পথ লইয়া রণাঙ্গনে স্থিতাবস্থা ধরিয়া রাখিয়াছে । এই যুদ্ধের জন্য পশ্চিমি সংবাদমাধ্যম আর কূটনীতিকেরা একতরফাভাবে পুতিনকেই দায়ী করিয়াছিল । যুদ্ধ শুরু হইবার পর তাহার পূর্বাভাস দিয়াছিলেন , এইবার পুতিনের দিন শেষ হইয়া আসিয়াছে । আবার ইউক্রেন যখন রণাঙ্গনে শক্ত তুলিয়াছিল সেই সময়ে এই সকল ভবিষ্যদ্রষ্টারা বলিয়াছিলেন , পশ্চিমি দেশগুলির অভূতপূর্ব নিষেধাজ্ঞার কারণে অচিরেই রাশিয়ার অর্থনীতি ধসিয়া পড়িবে । পুতিন সহসাই নতি স্বীকার করিতে বাধ্য হইবেন । এই সকল অর্থনীতির বিশ্লেষকেরা আরও বলিয়াছিলেন রাশিয়ার আল গার্কিদের সম্পদ এবং প্রমোদতরীগুলি বাজেয়াপ্ত হইতেছে পশ্চিমি দেশে । ইহার ফলে সহসাই পুতিনের মাথার ছাদ ভাঙিয়া পড়িবে ।
কিন্তু বাস্তবে এই সকল ঘটনা কিছুই ঘটিল না । ফলে এই সকল বিশে লষকেরা যে আসলে বিশ্লেষক কম , পশ্চিমি দেশগুলির প্রচারক বেশি তাহা বুঝিয়া লইতে দেরি হইলো না । আবার অদূর ভবিষ্যতেও যে রাশিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমি দেশগুলি এই ধরনের উদ্যোগ লইবে না তাহাও আজ দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট । কারণ প্রকৃত বাস্তবতা বিপরীত । রাশিয়ার জনমতের উপরে ভিত্তি করিয়া যে সমীক্ষা প্রকাশ হইতেছে ইদানীংকালে তাহাতে সেই দেশের মানুষ পুতিনের যুদ্ধের জন্য তাহাকে সমর্থন করিতেছে না বটে কিন্তু দেশের আর্থিক অবস্থা এই সময়ে খাদের কিনারা হইতে টানিয়া আনিতে পারিয়াছেন বলিয়া তাহারা পুতিনের পাশেই রহিয়াছেন । ইহা হইতে বুঝা যায় রাশিয়ার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ কিন্তু প্রকারান্তরে আগ্রাসী পুতিনের প্রতি সমর্থনই জানাইতেছেন । ইহার বড় কারণ হইলো অর্থনৈতিক ।
রাশিয়ার অর্থনীতি ধসাইয়া দিবার লক্ষ্যে বিস্ময়কর সকল অবরোধ জারি করা হইয়াছিল । আর এই ঘটনাকে উল্টো পথে পরিচালনা করিয়া দিয়া পুতিন ইহার সুফল আদায় করিয়া লইয়াছেন । রাশিয়ার তেল কিনিতে অস্বীকৃতি জানাইয়া ইউরোপ যখন গ্যাসের আমদানি কমাইয়া দেয় তাহাতে বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম বাড়িয়া যায় । ইহাতে রাশিয়ার বিক্রি কিন্তু কমিল না বরং উচ্চ মূল্যের কারণে তাহাদের কোষাগার ভরিয়া উঠিল । এই ঘটনার পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও পাশা উল্টাইয়া দিতে পারিয়াছেন পুতিন । বরাবর তাহার প্রচার ছিল , পশ্চিমি দেশ সকল রাশিয়াকে পদানত করিয়া রাখিতে চায় । পুতিন রাশিয়ার স্বার্থ রক্ষকের ভূমিকায় রহিয়াছেন । যুদ্ধ এবং যুদ্ধকালীন পশ্চিমি নিষেধাজ্ঞা পুতিনকে দেশবাসীর সামনে কিছুটা হইলেও সমীহ ফিরাইয়া দিয়াছে ।
রাশিয়ার গণমাধ্যম মারাত্মকভাবে ক্রেমলিনের প্রতি অনুগত । আবার রাশিয়ার মাটিতে দাঁড়াইয়া কেহ যুদ্ধবিরোধী কথা বলিবে , ইহাও সম্ভব নহে । কিন্তু এরপরও দেশের বিশাল অংশের মানুষ বিশ্বাস করেন রাশিয়া মানেই পুতিন নহে আর পুতিন মানেই রাশিয়া নহে । ভয়ের বাইরেও পুতিনের প্রতি অনুগত থাকিবার আরও বেশ কয়েকটি কারণ এখানে রহিয়াছে । যেমন , রাশিয়ার বহু ব্যবসায়ী এবং রাজনীতিক কিন্তু পৃষ্ঠপোষকতামূলক রাষ্ট্রীয় একটি ব্যবস্থার কারণে পুতিনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ । এই ব্যবস্থা পুতিনের আমলে এতোটাই গভীর যে ইহা ব্যতিরেকে তাহাদের সম্পদ এবং সামাজিক মর্যাদা প্রায় সবটাই নিশেষিত হইয়া যায় । দেশের একটি বৃহৎ অংশের মানুষ পুতিনের জাতীয়তাবাদী এজেন্ডাকে সমর্থন করিয়া থাকেন । কারণ তাহারা সোভিয়েত ভাঙিয়া যাইবার সময়কার সময়ের মূল্যায়ন করিয়া থাকেন । ওই সময়টি রাশিয়ার মর্যাদার উপর এক বিশাল ধাক্কা আনিয়াছিল ।
সর্বোপরি বরিস ইয়েলেতসিন রাশিয়াকে পশ্চিমি উদারীকরণের সঙ্গে মিলাইয়া দিতে চাহিয়া অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলা আর যন্ত্রণা ছাড়া আর কিছুই দিতে পারেন নাই বলিয়া তাহারা বিশ্বাস করেন । বিশ্বমঞ্চ এই ঘটনায় রাশিয়াকে দ্বিতীয় স্তরের শক্তিতে রূপান্তরিত করিয়াছিল । দুই দশক পর আবার সেই দিন রাশিয়ার জীবনে ফিরিয়া আসুক তাহা চান না কোনও রুশ নাগরিক । অতএব যুদ্ধ আরও একবছর ধরিয়া চলিলেও পুতিনের জনপ্রিয়তা কমিবে না , অন্তত রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক কারণে ।