মণিপুরে মুখ্যমন্ত্রীর বাড়িতে হামলা, বন্ধ ইন্টারনেট,, কার্ফু জারি!!
স্ট্রেস এবং মানসিক স্বাস্থ্য
—–ডাঃ অনির্বান দত্ত
ঘুম থেকে উঠেই প্রথম যে চিন্তাটি মাথায় আসে , তা হল ‘ ডেডলাইন ‘ , ‘ সেলস টার্গেট ‘ প্রভৃতি । যাঃ দিনটাই শুরু হয়ে গেল একটি উৎকণ্ঠা নিয়ে । কাল রাতের কাজগুলো আর শেষ করা হয়ে ওঠেনি । এই অর্ধসমাপ্ত কাজের চিন্তায় ঘুম আসতেও খানিকটা দেরি হয়ে গিয়েছিল । গতকালের মধ্যে সেলস রিপোর্ট শেষ করতে না পারায় কালকে অফিসে বসের কতটুকু গঞ্জনা সইতে হবে , তা ভাবতে ভাবতে একরকম ছটফটানির মধ্যেই অর্ধেক রাতের প্রহর গুনতে হয়েছিল । শেষ রাতে যাও কিছুটা ঘুম লাগল , একটা বিশ্রী স্বপ্ন এসে তাও মাটি করে দিল । সকালে একপ্রকারের তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থাতেই শয্যাত্যাগ করতে হল , অনেকটা ইচ্ছার বিরুদ্ধেই , না করে কি আর উপায় আছে ?
এই যান্ত্রিক সভ্যতার ইঁদুর দৌড়ে নিজেকে নিয়ে কি আর ভাবার অবকাশ আছে ? এত ভাবতে গেলে যে পিছিয়ে পড়তে হবে । শুভাকাঙ্ক্ষীরা বলেন যে এত স্ট্রেস নিচ্ছ কেন ? শুধু কি কাজ করলে চলে ? একটু নিজের শরীরের দিকেও দেখতে হয় — স্বাস্থ্যকর খাবার এবং পর্যাপ্ত ব্যায়াম ইত্যাদি ইত্যাদি ।
এই যে দেরি করে ঘুমানো— সেটা তো একটা অভ্যাস হয়ে গেল , কাজ থাক কী না থাক , এখন আর ঘুমও আসতে চায় না ঠিক সময়ে , বিছানায় পড়ে শুধু ছটফটাতে হয় । আর সারাদিন কাজের শেষে একটু ফেসবুক , ইনস্টাগ্রাম না করলে কী হয় ? তো এতেই অনেক রাত হয়ে যায় । তারপর সকালে উঠতে একটু দেরি হয়ে গেলে দৌড়তে হয় বাজারে কিংবা বাচ্চাদের তৈরি করে স্কুলের দিতে । এরপর তো নিজেরেই কাজের সময় হয়ে গেল তো ব্যায়ামের জন্য কোথায় আর সময় পাওয়া গেল ।
আর স্বাস্থ্যকর খাবার ! ওফ দু’মিনিট যে পাওয়া যায় কিছু একটা মুখে গোজার জন্য— হোক না কোনওদিন বেলা ১ টা কী অপরদিন ৩ টা , ব্রেক পাওয়া তো যাচ্ছে , তাই যথেষ্ট । একেক সময় তো বেলা চারটা পর্যন্ত কিছু না খেয়ে থাকতে হয় । উপরন্তু খাবারের গুণমান বিচার করার কথা তো প্রায়শই ভাবা যায় না । সমস্যা শুধু এখানেই থেমে নেই —ফিল্ড অপারেশনে যারা আছেন , যেমন ধরে নেওয়া যাক মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টিটিভদের কথাই । সেলস বা মার্কেটিং এক্সিকিউটিভদের মধ্যে যাদেরকে আমরা খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করতে পারি – পরিবারের সঙ্গে কিছুটা ভাল সময় কাটানোও যখন একপ্রকার বিলাসিতার পর্যায়ে দাঁড়ায় । কোভিড মহামারীর সময়কালে অন্যান্য কোভিড যোদ্ধাদের পাশাপাশি এদের অবদানও ছিল অনস্বীকার্য । অনেক পরিস্থিতিতে , যখন রোগীদের পক্ষে নিত্যব্যবহার্য তথা অপরিহার্য ।
ওষুধগুলো পাওয়া যাচ্ছিল না , তখন এই মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভরাই নিজেদের গতানুগতিক কর্তব্যের বাইরে গিয়ে এবং রোগাক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি নিয়েও ওষুধগুলো পৌঁছে দিয়েছিল । এই উদাহারণটি দেওয়ার অভিপ্রায় হল যে , অনেক সময় পরিশ্রম করার পরও উপযুক্ত বাহবা পাওয়া যায় না । কর্মক্ষেত্রে উপযুক্ত পারিশ্রমিকের পাশাপাশি উপযুক্ত মূল্যায়নও সমভাবে গুরুত্বপূর্ণ । যেকোনও একটি অথবা উভয়ের অভাবে কিংবা অতিরিক্ত কাজের চাপের ফলে জীবিকার প্রতি উৎসাহ উদ্দীপনা কম হতে থাকে এবং একসময় কাজ একটি বোঝা হিসেবে প্রতীয়মান হয় । পরিস্থিতির উন্নতি না হলে এই নিরুৎসাহতা তখন শুধু আর কাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না , এর পরিধি তখন ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক জীবনকেও নানাভাবেপ্রভাবিত করে ।
যেমন ধরুন — খিটখিটে থাকা এবং সহজেই বিরক্তিবোধ হওয়া , অল্প কাজেও ক্লান্তি বোধ হওয়া , পূর্বত আনন্দদায়ক কর্ম এবং সংসর্গে উদাসীনতা ইত্যাদি । সেই সঙ্গে অনেক সময় অস্থিরতা , দুশ্চিন্তা , মনোযোগ , ঘুম এবং খাদ্যাভ্যাসের সমস্যাও দেখা দিতে পারে । এই নানাবিধ মানসিক ক্লীবতার থেকে মুক্তি পেতে অনেক সময় ধূমপান , মদ্যপান কিংবা অন্যান্য নেশার কবলে পড়ার একটা আশঙ্কা তৈরি হয় । নেশার প্রসঙ্গ যখন আসলই , তখন আর এক প্রকার নেশার কথাও আলোচনা করা যাক , যা বর্তমানে যথেষ্ট উদ্বেগের বিষয় , সেটি হল ‘ কাজের নেশা ‘ । ১৯৭১ সালে জনৈক মার্কিন মনস্তত্ত্ববিদ ওয়েন ওটস ‘ Workaholism ‘ শব্দটির প্রবর্তন করেন । এর বৈশিষ্ট্যগুলি হল – অধিকাংশ সময় কাজের চাপ অনুভব করা এবং কাজের নির্ধারিত সময়ের বাইরেও কাজের কথাই ভাবতে থাকা , যার জন্য ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও আনন্দদায়ক দিকগুলো উপেক্ষিত হয় । ‘
Workaholism ‘ মতবাদটি এখনও অনেকটাই নতুন হওয়ায় , এটা নিয়ে নিরন্তর গবেষণা চলছে এবং অনেক বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের মতভেদ এখনও দূর হয়নি । তবে অনেক মনস্তত্ত্ববিদরাই মনে করেন , মাদক দ্রব্যের নেশার বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে এর অনেকখানি সাদৃশ্য আছে । এর সুফলগুলিকে ‘ Positive Work Engagement হিসেবে আখ্যা দিলেও , নিরন্তর স্ট্রেসের মধ্যে থাকার ফলে শরীর এবং মনের ওপর সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়ে । যেমন ধরুন , একসময় ডায়াবেটিস , রক্তচাপ এবং হৃদরোগের সমস্যা , বার্ধক্যজনিত রোগ হিসেবে চিহ্নিত ছিল । কিন্তু বর্তমানে যারাই নিরন্তর স্ট্রেসের মধ্যে জীবন অতিবাহিত করেন , তাদের ত্রিশ বছর বয়স থেকেই এসব রোগে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা বাড়তে থাকে । সুতরাং , দেখা যাচ্ছে উপযুক্তভাবে এই স্ট্রেসের প্রতিকার না করতে পারলে , জীবন ক্রমশ দুর্বিষহ হয়ে উঠবে , আর সঠিক প্রতিকারের জন্য কোনও মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের সুপরামর্শের দ্বারা স্ট্রেস মুক্তি সম্ভব ।