হারানো দিনের স্মৃতিতে কাতর আগরতলা

 হারানো দিনের স্মৃতিতে কাতর আগরতলা
এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

রাজ্যের সাংস্কৃতিক, সামাজিক অঙ্গনে একটি নতুন পরব হতে চলেছে দুর্গা বিসর্জনের কার্নিভাল। দুর্গোৎসব কেবল ধর্মপ্রাণ মানুষের আচার-অনুষ্ঠান আর ভক্তিশ্রদ্ধার বিষয় ছিল না কোনওকালেই । এই উৎসবের সামাজিক-সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিপ্রভাব বরাবরই বড় বাংলাকে প্রভাবিত করে এসেছে। খণ্ডিত বাংলার এই প্রান্তে দুর্গোৎসব রাজন্য ত্রিপুরার কাল চেয়ে বর্তমান সময়ে ভারত যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ণাঙ্গ রাজ্য ত্রিপুরার বড় উৎসব। বাঙালি-জনজাতির মিশ্র সংস্কৃতি দুর্গোৎসবকে যেভাবে উজ্জীবিত করে তারই চলচ্ছবি এ দিন দেখা গেল প্যারাডাইস চৌমুহনীর ‘মায়ের গমন’ সরকারী অনুষ্ঠানের মঞ্চে। কৌতূহলী মানুষের উচ্ছ্বাসের সাক্ষী রইল আলপনায় উদ্ভাসিত রাজপথ ।

গড়িয়া থেকে হজাগিরি, গাজন থেকে ধামাইল সব মিলেমিশে দুর্গোৎসবের মহত্ব এ দিন প্রকাশ হলো লোকজ চর্চা আর নগরবাসীর রুচিশীলতায়। সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় দুর্গাপুজোর বিসর্জনের সাধারণ আচার অসাধারণ হলো। নগর আগরতলা জানান দিতে পারলো তার নিজ সংস্কৃতি আর পরখ করে নিতে পারলো গড় নগরবাসীর রুচি আর সাংস্কৃতিক প্রত্যাশার। উল্লেখযোগ্য পুজোগুলি তাদের প্রতিমা নিরঞ্জনের পথ হিসাবে সবাই ছুঁয়ে যায় কার্নিভাল মঞ্চ। বিকাল পাঁচটায় অনুষ্ঠানের সূচনায় সাংস্কৃতিক নৃত্য, গীত, বাদ্যে মুখরিত হয় প্যারাডাইস চৌমুহনী চত্বর। সিটি সেন্টার চত্বরের মঞ্চে তখন উপস্থিত মুখ্যমন্ত্রী ডা. মানিক সাহা সহ মন্ত্রিসভার গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীরা।

বৃষ্টিতে এ বছর বারবার উৎসবের আনন্দে ছন্দপতন ঘটেছে। কিন্তু শেষ বেলায় দুর্গা বিসর্জনে কার্নিভাল যেন সব আপশোস পুষিয়ে দিয়েছে। রাজ্য তথ্য সংস্কৃতি দপ্তরও এই ক্ষেত্রে সফল বলা যায়। মায়ের গমন অনুষ্ঠানের সূচনা করে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, কোভিড অতিমারীর কারণে বিগত দু’বছর দুর্গাপুজোর বিজয়া দশমীর বিসর্জন সেভাবে আকর্ষণীয় হয়ে ওঠেনি। এবার তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তরের উদ্যোগে দুর্গাপুজোর বিসর্জন উপলক্ষে মায়ের গমন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সুষ্ঠুভাবে আগরতলার ক্লাবগুলির প্রতিমা নিরঞ্জনের উদ্দেশেই এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সরকার রাজ্যের চিরন্তন সংস্কৃতিকে তুলে ধরার প্রয়াস নিয়েছে।

উপমুখ্যমন্ত্রী যীষ্ণু দেববর্মণ বলেন, দুর্গাপুজো রাজ্যের একটি ঐতিহ্যবাহী উৎসব। জাতপাত ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল অংশের মানুষ এই উৎসবে অংশগ্রহণ করে দুর্গা মায়ের নিকট সুন্দর ও সমৃদ্ধশালী সমাজের প্রার্থনা করেন। তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রী সুশান্ত চৌধুরী বলে, রাজ্যের উৎসবের মেজাজকে আরও সুদৃঢ় করতে ‘মায়ের গমন’ অনুষ্ঠানের আয়োজন। একটা প্রতিযোগিতামূলক মানসিকতা নিয়ে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। তিনি বলেন, বিজয়া দশমীর প্রতিমা বিসর্জনকে স্মরণীয় করে রাখাই এই অনুষ্ঠানের মুখ্য উদ্দেশ্য। আগামীদিনে আগরতলা শহর ছাড়াও জেলা ও মহকুমা শহরেও এ ধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে।

এ ধরনের অনুষ্ঠান আয়োজনে আগরতলা পুর নিগম, আরক্ষা প্রশাসন সহ বিভিন্ন দপ্তর যেভাবে সহযোগিতা করেছে তার প্রশংসা করেন। এরপরই শুরু হয় বিভিন্ন ক্লাবগুলি, আয়োজক সংস্থার প্রতিমা নিয়ে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা। একসময় রাজধানী আগরতলায় দশমীর শোভাযাত্রা ছিল এই শহরের অন্যতম এক পুজো আকর্ষণ। প্রথমে দুর্গাবাড়ির প্রতিমা এগিয়ে যেত পুলিশের বিউগলের তালে তালে। এরপর প্রভুবাড়ির প্রতিমা ক্রমান্বয়ে বিভিন্ন ক্লাবগুলির প্রতিমা একে একে যেত বটতলা পেরিয়ে দশমীঘাটে, হাওড়ার নিরঞ্জন ঘাটের দিকে। এই শোভাযাত্রা শুরু হতো উজ্জয়ন্ত প্রাসাদের সামনে থেকে।

জ্যাকশন গেট, কামান চৌমুহনী হয়ে পোস্ট অফিস চৌমুহনী ছুয়ে সোজা দশমীঘাট – এই রাস্তার দুই পাশে দাঁড়িয়ে পড়তেন হাজার হাজার মানুষ। আর কৌতুহলে ভাসতো শহর। দেখেও শেষ হতো না। দেখা।
আশির দশকে ক্লাব সংস্কৃতি মারামারি আর দাঙ্গাহাঙ্গামা কেন্দ্রিক হয়ে পড়ায় সরকারীভাবে প্রতিমা নিরঞ্জনের আনুষ্ঠানিকতা বাতিল করা হয়। দশমী আর যুথবদ্ধ শোভাযাত্রায় করা হয়নি। প্রসঙ্গত, সে সময়ে উজ্জয়ন্ত প্রাসাদ চত্বর থেকে মিছিল শুরুর যে রেওয়াজ ছিল তার সূচনা রাজ আমলের। তুলসীবতী স্কুল হোস্টেলের দরজায় যে কাঠামো আজও দাঁড়িয়ে আছে, সেটি ছিল নহবত।

বিজয়াদশমী কিংবা অন্য যে কোনও শোভাযাত্রার সময়ে মহারাজা, রাণী ও আমাত্য সমভিব্যাহারে নহবত খানায় বসে নিরীক্ষণ করতেন এবং আহ্বান জানাতেন। আশির দশকে ক্লাবগুলির মারামারি সংস্কৃতি বন্ধে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড এবং আরও পরে রক্তদান ইত্যাদি আনা হয়। এতে উদ্দেশ্য সর্বাংশে পূরিত না। হলেও ক্লাবকেন্দ্রিক মারামারি বন্ধ হয়। এবার দুর্গাপুজোয় সরকারীভাবে ‘মায়ের গমন’ নামে যে কার্নিভাল আয়োজন করা হয়েছে তা হারানো আগরতলাকে ফিরিয়ে দিল। শারদোৎসবে আগরতলাবাসীর জন্য এক বড় উপহার।

Dainik Digital

Dainik Digital

Leave a Reply

Your email address will not be published.