সংঘাত কাম্য নয়
রাজ্যপাল বনাম রাজ্য সরকারের মধ্যে বিরোধ ভারতের মতো যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোতে নতুন কোন বিষয় নয়। রাজ্যপালের ক্ষমতা, এক্তিয়ার, দায়িত্ব, কর্তব্য—এই বিষয়গুলো নিয়ে বিভিন্ন সময়ে এদেশে প্রচুর বিতর্ক হয়েছে। এক সময় দেশ থেকে রাজ্যপালের পদটিকে বিলুপ্ত করার দাবি জানিয়ে কম বিতর্ক হয়নি। কিন্তু রাজ্যপালকে নিয়ে বিভিন্ন সময়ে রাজ্য সরকারগুলোর দ্বৈরথ কমেনি। বিভিন্ন সময়ে অভিযোগ উঠতে শোনা গেছে, রাজ্যপাল কেন্দ্রের এজেন্ট হয়ে কাজ করছেন। কখনও অভিযোগ উঠছে ভারতের সংবিধানে রাজ্যপালকে যে ক্ষমতা ও দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, সেই সাংবিধানিক সীমাকে ছাড়িয়ে রাজ্যপাল রাজ্যের সঙ্গে অনাবশ্যক ঝামেলা করছেন।
পূর্বতন প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত ইন্দিরা গান্ধীর সময়ে রাজ্যপালকে দিয়ে একাধিকবার ক্ষমতা বহিঃর্ভূত ভাবে বিরোধী দল পরিচালিত রাজ্য সরকারগুলোকে শায়েস্তা করার বেশ কিছু নজিরও আছে। এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিস্তর রাজনীতির জলঘোলাও হয়েছে। কিন্তু অতি সাম্প্রতিককালে দেশজুড়ে অ-বিজেপিশাসিত রাজ্যগুলোর সঙ্গে রাজ্যপালদের সম্পর্ক যে পরিমাণ তিক্ততার পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছোচ্ছে তা যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর সমস্ত সীমা-পরিসীমাকেই হয়তো ছাপিয়ে যাচ্ছে। আর এই ধরনের প্রবণতা ভারতের মতো গণতান্ত্রিক দেশে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় একেবারেই যে সুস্থতার লক্ষণ নয় সেটা হলপ করেই বলা যায়।
১৯৫৯ সালে দেশে প্রথম রাজ্যপালের রিপোর্টের ভিত্তিতে সরকার ফেলে দেওয়ার ঘটনাটি ঘটেছিল জওরলাল নেহরুর প্রধানমন্ত্রীত্বের কালে। এই ঘটনাটি ঘটেছিল কেরালার প্রথম কমিউনিস্ট সরকারের মুখ্যমন্ত্রী ইএমএস নাম্বুদিপাদের সঙ্গে। তারপর বিভিন্ন রাজ্যে ভিন্ন ভিন্ন কারণ দেখিয়ে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে দেখা যাচ্ছে। বর্তমান সময়ে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে সরকার ফেলে দেওয়ার সেই পুরনো খেলা অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব হলেও দিন যত গেছে রাজ্যপাল বনাম রাজ্য সরকারের মধ্যেকার বিরোধের তিক্ততা বেড়েছে। পশ্চিমবঙ্গে এর মমতা-ধনখড়ের বিরোধ গোটা দেশের মানুষের কাছে অজানা নয়।
মমতা-ধনখড় বিরোধের জের সম্প্রতি উপরাষ্ট্রপতি পদে খনখড়ের মনোনয়নের মাধ্যমে অবসান ঘটে। কিন্তু গত কয়েকমাস ধরে কেরালায় লেফট ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট সরকারের সঙ্গে রাজ্যপাল আরিফ মহম্মদ খানের বিরোধ যে মাত্রায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে তা পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে কোনও অংশে কম নয়। পরিস্থিতি এতটাই উদ্বেগের যে রাজ্যপাল আরিফ মহম্মদ খানকে আরএসএসের এজেন্ট বলে আখ্যা দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন। রাজ্যপালকে না জানিয়েই কেরালা ৯ টি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগ করেছিল সরকার। রাজ্যপাল পাল্টা এই ৯ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে পদত্যাগের নির্দেশ দেন।
তারপর থেকেই শুরু হয় বিরোধ। বিজয়নের অর্থমন্ত্রী এ প্রসঙ্গে রাজ্যপালের কড়া সমলোচনা করেছিলেন। রাজ্যপাল এই ঘটনাকে গুরুতর অপরাধ আখ্যা দিয়ে অর্থমন্ত্রীকে বরখাস্ত করার জন্য চিঠি লেখেন বিজয়নকে। এ নিয়েই শুরু হয় মহান্ত্রিরণ। কেরালা সরকার এবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে সিদ্ধান্ত নিয়ে সমস্ত সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজ্যপালের বদলে আচার্য তথা চ্যান্সেলর পদে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ নিয়োগ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং রাজ্যপালের কাছে সেই অর্ডিন্যান্স জারি করার জন্য পাঠানোর কথা জানায়। অর্থাৎ মমতার দেখানো পথেই ধনখড়ের উত্তরসূরী হিসেবে কেরালার ১৪ টি বিশ্ববিদ্যালয়ে চ্যান্সেলর পদ থেকে রাজ্যপালকে হটানোর বিষয়টি এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা।
কারণ মন্ত্রিসভার গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুমোদন দেওয়া ছাড়া রাজ্যপালের কোনও বিকল্প নেই। রাজ্যপাল বনাম রাজ্যে সরকারের মধ্যেকার বিরোধ শুধু পশ্চিমবঙ্গ বা কেরালায় সীমাবদ্ধ-এরকমটা মনে করা বড়সড় ভুল। কারণ দক্ষিণের দুই রাজ্য ও ঝাড়খণ্ডে একই সমস্যা চলছে। তামিলনাড়ুর এ রবি, তেলেঙ্গানার টি সুন্দররাজন এবং ঝাড়খণ্ডের রমেশ বৈশ-এই তিন রাজ্যপালকে নিয়েও রাজনীতির কালো মেঘ ক্রমেই ঘণীভূত হচ্ছে। প্রসঙ্গ এখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য পদ নিয়ে নয়। সমস্যাটি হলো, রাজ্যপালকে নিয়ে বিরোধ কংগ্রেস আমলেও ছিলো। এখনও আছে।
কিন্তু বর্তমানে কেন্দ্রে বিজেপি শাসনকালে অ- বিজেপিশাসিত রাজ্যগুলোতে রাজ্যপালদের ‘দলদাসত্বে অভিযোগ যে দৃষ্টিকটু ও দ্বিধাহীন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে তাতে এই পরিস্থিতি ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় গণতান্ত্রিক কাঠামোর জন্য ভালো লক্ষণ নয়। ভারতের সংবিধানে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় কেন্দ্র ও রাজ্যের সম্পর্কের মাঝখানে রাজ্যপালের ভূমিকা ও কর্তব্য কী হবে সেটা স্পষ্ট ভাবে উল্লেখ আছে। বলা আছে রাজ্যপাল হবেন সংবিধান ও আইনের ধারক ও রক্ষাকর্তা। তার কাজ প্রায় নেই, কিন্তু কর্তব্য অনেক। এখানেই সংবিধান রাজ্যপালের কর্তব্যপরায়ণ রূপটি দেখতে চায়। তার ক্ষমতাদর্পী রূপ নয়।
এটা হচ্ছে না বলেই যুগে যুগে এই বিরোধ চলে আসছে। সারকারিয়া কমিশন বহু আগে রাজ্যপাল ও রাজ্য সরকারের বিরোধ নিরসনে একাধিক প্রস্তাবের কথা বলেছিল। তার মধ্যে অন্যমত ছিলো রাজনীতির বাইরের লোককে রাজ্যপাল পদে বসানো। কিন্তু সেটা সর্বক্ষেত্রে হচ্ছে না এবং হলেও অরাজনৈতিক ব্যক্তিরাও ইদানীং রাজনৈতিক কাজে নিজেদের সিদ্ধান্তকে জড়িয়ে ফেলছেন। এর থেকে বেরিয়ে আসার দায়িত্ব সর্বাগ্রে কেন্দ্রীয় সরকার এবং কিছু অংশে রাজ্যকে ভূমিকা নিতে হবে। সেটা সম্ভব করা গেলেই ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় গণতান্ত্রিক কাঠামো মজবুত হবে।