বারাসাতের বিখ্যাত কালীপুজো, বিগ-জায়ান্টদের টক্কর দিতে তরুছায়া, শতদলের মানবিক থিম
সুজয় গুহ, কলকাতা
কলকাতায় যখন দুর্গাপুজোর খুঁটি পূজার শুরু হয় ঠিক তখনই অনতি দূরেই শ্যামা পূজার কাউন্টডাউনও শুরু হয়ে যায়। পুজোকে কেন্দ্র করে দর্শক সমাগম যদি মাপকাঠি হয় তাহলে নিঃসন্দেহে কলকাতার দুর্গাপুজোর মতো চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পুজো, এমন কি নবদ্বীপের রাস উৎসবের মতোই বারাসাতের কালীপুজোর ঐতিহ্য অন্যতম। আর তাই দুর্গাপুজোর অনেক আগে থেকেই এখানে প্রায় নিঃশব্দে চলে শতাব্দী প্রাচীন দলগুলির দেবীর কালী রূপে বরণের প্রক্রিয়া।
একদিকে যেমন, বারাসাতের যেসব পুজোগুলি আর্থিক সংগতিতে ধারে এবং ভারে আকাশছোঁয়া প্যান্ডেল এবং অবাক করা আলোর রোশনাইয়ে অন্যান্যদের প্রচারের আলো কেড়ে নেয়, তাদের মধ্যে অন্যতম কেএনসি রেজিমেন্ট, পাইওনিয়ার পার্ক, ফ্রেন্ডস অ্যাসোসিয়েশন, নবপল্লী সর্বজনীন, নবপল্লী আমরা সবাই। আর স্বাভাবিকভাবেই দর্শনার্থীদের একটা বিরাট অংশের ভিড় এইসব পূজা প্যান্ডেলে উপচে পড়ে। যদিও প্রশাসনের সাম্প্রতিকতম নির্দেশে বিভিন্ন ধরনের পাস এবং ভিআইপি কার্ড এবারে বাতিল হওয়ায় কলকাতা এবং শহরতলীর বিভিন্ন অংশ থেকে লক্ষ লক্ষ দর্শনার্থীরা উপকৃত হবেন।
অপরদিকে এবারের শ্যামা পূজায় অসাধারণ থিম ভাবনায় নিজেদের ক্লাব প্রাঙ্গণ সাজিয়ে তুলেছে তরুছায়া, শতদলের মত অন্যান্য ক্লাবও। মানুষের জন্য একান্তভাবে মানুষের পাশে থেকে মানবিক দিক তুলে ধরাই এইসব ক্লাবের থিমের মূল ভাবনা। তরুছায়া ক্লাব ৫৩ বছরের মাতৃ আরাধনায় থিম রেখেছে “দৃষ্টিকোণ”। দলের এবারের থিমের ব্যাখ্যায় কোষাধ্যক্ষ অভিষেক সূর জানিয়েছেন, পৃথিবীর আপেক্ষিক গতিপথে এক মানুষের চোখে অন্যকে দেখার আঙ্গিক হল এই দৃষ্টিকোণ। পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুরের শিল্পী টোটন মান্না এবং তার সহযোগীরা এই দৃষ্টিকোণের ভাবনা ফুটিয়ে তুলবেন তরুছায়া ক্লাব প্রাঙ্গনে। আলোর দায়িত্বে রয়েছে মাতারাঙ্গী ইলেকট্রিক। তরুছায়া দলের কর্ণধার সুরজিৎ সূর ও অনিমেষ সাহা জানিয়েছেন, শুধু পুজো করাই তো একমাত্র উদ্দেশ্য নয়। পুজো, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং এর পাশাপাশি দুস্থ মানুষদের জন্য বস্ত্র বিতরণের অনুষ্ঠানও থাকছে। এছাড়াও সারা বছর ধরে রক্তদান শিবির, সাফাই কর্মীদের সংবর্ধনা অনাথ শিশুদের বস্ত্র দান এছাড়া অন্যান্য সামাজিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকেন তারা। তরুছায়া দলের এবারের পূজা সম্পাদক রূপায়ন ভট্টাচার্য মনে করেন, “পুজোর লড়াইয়ে নেমে লাভ নেই। বরং আমাদের উদ্দেশ্য সাধারণ মানুষের বিপদে-আপদে পাশে থাকা। আর তাই মানুষের মানবিকতাকে মূলধন করেই আমাদের এ বছরের থিম দৃষ্টিকোণ। আমাদের দেখার ভঙ্গি পাল্টাক, মানুষের প্রয়োজনে মানুষ পাশে পাক তার প্রিয় মানুষকে।”
বারাসাতের আরেকটি ঐতিহ্যবাহী ক্লাব সংগঠন শতদলের এ বছরের পূজোর ভাবনায় রয়েছে “স্বপ্ন-সুন্দর প্রকৃতির প্রত্যাশা”। শতদল ক্লাবের সদস্য সমীরবাবু জানিয়েছেন, এবারের পূজোর শিল্পী অরিন্দম মজুমদার। নাগপুরের বিশেষ শিল্পীরা প্রায় এক মাস আগে থেকেই স্বপ্ন সুন্দর প্রকৃতির প্রত্যাশায় শতদলের ক্লাবের মাঠে কাজ করে চলেছেন। দলের কর্ণধার দুলাল কুন্ডু এবং সভাপতি তপন কুমার ভৌমিক জানালেন, শতদল একটি অতি প্রাচীন ক্লাব সংগঠন। প্রচুর মানুষ এখানে শহর এবং শহরতলীর বাইরে থেকে আমাদের ঠাকুর দেখতে আসেন। প্রত্যেক বছরের মতো এবছরও নরনারায়ণ সেবা সহ দুস্থ মানুষদের বস্ত্র বিতরণ থাকছে দলের চিরাচরিত কর্মসূচির অঙ্গ হিসেবে। আর তাই ক্লাবের ঐতিহ্য বজায় রাখতে শতদলের ৫৪ বছরের পুজোয় অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন সমীর ঘোষ, সমীর দে, বাবাই, বাবুসোনা, নিত্যর মতো আরও ক্লাব সদস্যরা।
এবারে যদি থিমের ভাবনায় বিগ জায়ান্টদের কথায় আসি, তাহলে প্রথমেই আসা যাক বারাসত কেএনসি রেজিমেন্ট এর পুজোয়। প্রতিবছরই দর্শনার্থীদের নজরে থাকে এই ক্লাব। এ বছর এই ক্লাবের চিন্তাভাবনায় “আলোর খেলায় ভেসাক মেলায়”। শ্রীলংকার ভেসাক ফেস্টিভ্যাল-এর অনুকরণে তৈরি করা হবে মণ্ডপ। পাইওনিয়ার পার্ক শ্যামাপুজোয় এবারের থিম সুদূর সাউথ আফ্রিকার মরক্কো কসবা টাওয়ার। বুর্জ খলিফা বা ট্যুইন টাওয়ারের পর এবার এই মরক্কো টাওয়ার বিশেষ আকর্ষণ হিসেবে নজরে থাকবে দর্শনার্থীদের। নবপল্লীর আমরা সবাই ক্লাবের এবারের থিম কর্ণাটকের সুখ প্রাচীন ও জাগ্রত কোটি লিঙ্গেশ্বর শিব মন্দির। অপর জায়ান্ট ক্লাব, নবপল্লী সর্বজনীনের এবারের ভাবনায় উঠে আসছে “কেদারনাথ মন্দির”।
এছাড়াও সন্ধানী, বিদ্রোহী, ছাত্রদলের মতো অসংখ্য ক্লাব সংগঠন শ্যামাপূজায় খুব সুন্দর মন্ডপসজ্জার পরিকল্পনা এবং রূপায়ণ করে থাকেন যা অবশ্যই দৃষ্টিনন্দন ও তারিফযোগ্য। আর স্বাভাবিকভাবেই, গত দুবছরের কোভিডের গৃহবন্দী জীবন উপেক্ষা করে যে এই বছর মানুষের ঢল নামতে চলেছে বারাসাতে, তা বলাই বাহুল্য।